ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক নারীকে বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল সূত্রে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ নারীপাচার চক্রের সন্ধান। চক্রটি টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁদ পেতে চাকরির প্রলোভনে দীর্ঘদিন ধরে এই অপকর্ম চালিয়ে আসছে।
এই আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের অন্যতম মূলহোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিসহ (৩০) চার জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব জানায়, মানবপাচারকারী এ চক্রের সঙ্গে প্রায় ৫০ জন জড়িত। গ্রেফতার রাফির মাধ্যমে গত ৮ বছরে অন্তত ৫০০ নারীকে ভারতে পতিতাবৃত্তিতে পাচার করা হয়েছে।
গ্রেফতার বাকি তিন জন হলেন- রাফির অন্যতম নারী সহযােগী সাহিদা বেগম ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মাে. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মাে. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ (২৬)।
মঙ্গলবার (০১ জুন) সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ভারতে ভুক্তভােগী এক তরুণীর বাবা গত ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিতে র্যাব ওই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গােয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এর ধারাবাহিকতায় সোমবার (৩১ মে) থেকে মঙ্গলবার (০১ জুন) পর্যন্ত র্যাব সদর দপ্তরের গােয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর অভিযানে ঝিনাইদহ সদর, যশােরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেকে নারী পাচার চক্রের মূলহােতা মাে. আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতো চক্রটি। দেশি-বিদেশিসহ প্রায় ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
নারীদের যেভাবে পাচার
রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় টিকটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে বিভিন্ন বয়সের নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই গ্রুপের তরুণীদের মডেল বানানো ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টিকটক হৃদয় আকৃষ্ট করতেন। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন সুপারমল, সুপারশপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তরুণী ও নারীদের বস রাফির সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করতেন। পার্শ্ববর্তী দেশে তাদের পাচারের পর প্রথমে একটি সেফ হাউজে নেওয়া হতো।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সেফ হাউজে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে মাদক সেবন করতে বাধ্য করতো তারা। মাদক সেবনের পর তাদের জোর পূর্বক যৌন নির্যাতন করে এসব ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হতো। যাতে তাদের পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করা যায়।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হত। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি সম্পন্ন করতো।
সীমান্তবর্তী সেফ হাউজ-কলকাতা হয়ে বেঙ্গালুরু
প্রথমত ভিকটিমদের দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসা হয়। এরপর ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে রাখা হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হয়। পরে পাশ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদেরকে গ্রহণ করে সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখতো।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, সীমান্ত এলাকা থেকে সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠানো হতো। এর পরের ধাপে কলকাতা থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু পাঠানো হতো।
পাচারকৃত নারীরা বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেফতার বস রাফি তাদের গ্রহণ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে রাখতেন। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্থকরণ ও অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে পতিতাবৃত্তি পেশায় বাধ্য করা হতো।
সেফ হাউজগুলো থেকে তাদেরকে ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরদেরকে সরবরাহ করা হতো। এক্ষেত্রে পরিবহণ ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হতো। পাশ্ববর্তী দেশের এজেন্ট তাকে খদ্দের প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন দিতো। ক্ষেত্রবিশেষে নারীদেরকে অর্থের বিনিময়ে বিক্রিও করা হতো।
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা এক তরুণীকে নির্যাতনের কারণ
গ্রেফতার রাফি জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানায়, ভারতে কিশোরগঞ্জের নির্যাতিত ওই নারী দুজন বাংলাদেশি নারীকে দেশে পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করায় তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়। তাকেও বলা হয় সে যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ধারণ করা ভিডিওটি স্বজনদের কাছে পাঠানো দেওয়া হবে।
বস রাফি কে?
গ্রেফতার বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। বিগত ৮ বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত রয়েছে। তিনি সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার, হোটেলে রিসোর্টে কর্মচারী ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। ভারতে গিয়েই তিনি নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত হন। বিগত ২ বছর আগে টিকটকের মাধ্যমে হৃদয়ের সঙ্গে বস রাফির পরিচয় হয়। সে টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীকে পাশ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্ট রয়েছে।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ভিকটিমকে পাচারের উদ্দেশ্যে টিকটক হৃদয় প্রলুব্ধ করে। পরে বস রাফি তাকে গত বছরের অক্টোবর মাসে পাচার করে বেঙ্গালুরে নিয়ে সেফ হাউসে অবস্থান করায়, যেখানে নির্যাতনের ভিডিওটি ধারণ করা হয়।
বস রাফির বিষয়ে র্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার বস রাফি গত ৮ বছর ধরে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে ছিলেন। প্রথমে সেখানে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন, পরবর্তীতে রিসোর্টে চাকরি করেছেন। তিনি তামিল ভাষায় খুব দক্ষ। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর যেসব হোটেল-রিসোর্টে অবৈধ্য কার্যক্রম হত সেসব হোটেলের লোকদের সঙ্গে রাফির ভালো সম্পর্ক হয়। ৮ বছরে ৫০০ নারীদেরকে রাফি ভারতে পাচার করেছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছি।
মা-মেয়ে নারীপাচার চক্রে সক্রিয়
বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার একাধিক বিয়ে হয়েছিল। ম্যাডাম সাহিদা ও তার দুই মেয়ে সোনিয়া-তানিয়াও নারী পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরে অবস্থান করছে বলে সাহিদা জানায়।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে আরেকজন নারীকে সহযোগী হিসেবে দেখা গেছে, তিনি তানিয়া বলে জানা গেছে। সাহিদা বাংলাদেশে একটি সেফ হাউস পরিচালনা করতেন। সেফ হাউজে বিভিন্ন নারী সংক্রান্ত অবৈধ কার্যক্রম করা হয়। এ অবৈধ ব্যবসায় সে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জড়িত।
এছাড়া গ্রেফতার ইসমাইল ও মো. আব্দুর রহমান মূলহোতা বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকেন। তারাও নারী পাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
গ্রেফতার ম্যাডাম সাহিদা সম্পর্কে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ম্যাডাম সাহিদা গত ১০ বছর ধরে ভারতে মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। যশোরের সীমান্ত এলাকায় সাহিদার তত্ত্বাবধানে একটি সেইফ হাউজ রয়েছে।
দালালরা সীমান্ত কীভাবে ম্যানেজ করতেন জানতে চাইলে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, দালালরা যশোরের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্নভাবে সীমান্ত ম্যানেজ করত। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন। সীমান্তে যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল থাকতো তখন পাচারকারীরা নারীদেরকে পাচার করতো। অনেক সময় কাঁটাতারের বেড়া কেটে নারীদের ভারতে পাচার করতেন তারা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় ভারতে নারী পাচার করতো চক্রটি। পাচারের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত বাংলাদেশি নারীদেরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে তারা। একটি গ্রুপে মধ্যবিত্তদের আরেকটি ছিল নিম্ন মধ্যবিত্তদের। মধ্যবিত্ত নারীদেরকে ভারত থেকে দুবাইয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত নারীদেরকে ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হতো।
বাংলাদেশ সময়: ২২৩৪ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০২১
পিএম/কেএআর