ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ আশ্বিন ১৪৩১, ০১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাঁকখালীতে ড্রেজিং: শেষ পর্যন্ত নদীতেই গেল নদীর বালু

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০২১
বাঁকখালীতে ড্রেজিং: শেষ পর্যন্ত নদীতেই গেল নদীর বালু

কক্সবাজার: কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পে নদী থেকে উত্তোলন করা বালু নদীর বুকে রেখেই চলছিল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী আশঙ্কা করছিল নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বালু নদীতেই চলে যাবে।

এতে বহু আকাঙ্ক্ষিত এ প্রকল্পের সুফল পাবে না এলাকাবাসী।  

শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসীর আশঙ্কা সত্যি হলো। গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় রামুর আতিক্কাবিবির ঘাট, হাইটুপি, ভুতপাড়া, গাউচ্ছাপাড়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নদী থেকে উত্তোলন করা বালুর সিংহভাগ নদীতেই তলিয়ে গেছে। এমনকি নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় কারণে বালু তুলে আনা কঠিন হয়ে গেলে গত বৃহস্পতিবার (৩ জুন) রামুর হাইটুপি ও ভুতপাড়া অংশে রাতের আঁধারে স্কেভেটর দিয়ে বিপুল পরিমাণ বালু পানিতে মিশিয়ে দিয়েছে স্বয়ং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।  

গত ২৫ এপ্রিল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এ ‘নদীর বালু নদীতে রেখেই চলছে ড্রেজিং’ ও ২৭ এপ্রিল ‘বাঁকখালী ড্রেজিং কার্যাদেশের আগেই ৬ কোটি টাকার বালু বিক্রি’ শিরোনামে দু’টি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।  

গত ২৫ এপ্রিল প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওইদিনই কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং নদীর বুকে মজুদ করা বালু পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে তুলে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রায় দেড় মাস হলেও সেই নির্দেশনা মানা হয়নি।

স্থানীয় ভুতপাড়ার বাসিন্দা ও একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত নুরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রীতিমতো অবাক হয়েছি। ড্রেজিং করে তোলা বালু রাতের আঁধারে স্কেভেটর দিয়ে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে এগুলো দেখার কেউ নেই।  

কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রকল্প বাঁকখালী ড্রেজিং। কিন্তু এ রকম জনগুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের কাজ চলছে নানা অনিয়মের মধ্যে দিয়ে। নদীর বালু নদীতে রেখে এ রকম অভিনব ড্রেজিং কার্যক্রম কোথাও দেখিনি। যোগ করেন- নুরুল আমিন।  

ভুতপাড়ার বাসিন্দা মো. আলী (৫৩) বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রতিদিন দেখি বিকেল ৫টা পর্যন্ত ড্রেজিংয়ের কাজ চালানো হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১টার দিকে বের হলে দেখি স্কেভেটর দিয়ে বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। পরে বুঝতে পারলাম নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে বালুগুলো তুলতে না পেরে পানিতে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।  

কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মেম্বার স্থানীয় বাসিন্দা মো. বদরুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কে বা কারা ড্রেজিং কাজ পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শনের পর সন্ধ্যায় দেখি বালুগুলো পানিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিষয়টি আমরা বুঝে ওঠতে পারিনি। পরে মনে হয়েছে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের এ কৌশল।  

বাঁকখালী ড্রেজিং এখানকার মানুষের বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এ প্রকল্পের অনিয়ম বন্ধে প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।  

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন রামুর সভাপতি মাস্টার মো. আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সুজনের পক্ষ থেকে প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছি। নদীর বালু নদীতে রেখে অভিনব ড্রেজিংয়ের কাজ দেখে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমরা বার বার আশঙ্কা প্রকাশ করেছি এসব বালু পানি বাড়লেই নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। তাই রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে জানিয়েয়েছি। ইউএন আমাদের কথাগুলোর এক পয়সারও পাত্তা দেননি। পরে আমরা জেলা প্রশাসক বরাবরও স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।  

খালের বালু খালেই থাকছে। এমনকি হাইটুপি অংশের পাশে ৪০ মিটার ড্রেজিংয়ের কথা থাকলেও তা নিয়ম অনুযায়ী করা হচ্ছে না বলে স্থানীয় লোকজন আমাদের জানিয়েছে। এখন আমরা সিদ্বান্ত নিয়েছি এটা নিয়ে আমরা আন্দোলনে যাবো। যোগ করেন-আলম।  

এদিকে অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. সরওয়ার আলম বাংলানিউজকে বলেন, ভুতপাড়া অংশে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলার কারণে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে নদী তীরের সিসিব্লক ধসে যাওয়ার আশঙ্কা আছে সেজন্য কিছু বালু পানিতে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে রাতের আঁধারে বালু বিলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।  

তবে পানি বাড়ায় নদীতে বালু বিলীন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এগুলো আমরা আবার তুলে ফেলবো। ফাইনাল পোস্ট ওয়ার্কের পর যতটুকু কাজ ততটুকুই তাদের বিল পরিশোধ করা হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও সংযোগ ঘটেনি।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ড. মো. মামুনুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি সরাসরি পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখেন। আমি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।

প্রকল্পে যা যা আছে
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বাঁকখালী নদী ড্রেজিং ও খনন করে নদীর নাব্যতা বাড়ানোর মাধ্যমে নৌচলাচলের পথ সুগম করা, দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সাগরে নৌকা/ট্রলার নিরাপদ অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পোতাশ্রয় হিসেবে বাঁকখালী নদী ব্যবহার করা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নদী ভাঙনের হাত থেকে ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য ২০১৬ সালে প্রায় ১৯৫ কোটি ৫৪৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প গ্রহণ করে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

প্রকল্পে নদী ২৮ কিলোমিটার ড্রেজিং ছাড়াও রয়েছে ৪.৬৫০ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ, তিন কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ/ পুনরাকৃতিকরণ, দু’টি রেগুলেটর নির্মাণ ও ১২ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের কাজ। ২০১৬ সালের জুনে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি মাস জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্প এটি। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দুই উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ১৯ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। বন্যা থেকে রক্ষা পাবে রামু সদরের তিন লাখ মানুষ। পাশাপাশি নদী ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পাবে অন্তত দুই হাজার পরিবার।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, ০৬, ২০২১
এসবি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।