ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

১ কেজি বাদাম ছিঁড়ে মেলে ৪ টাকা!

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৬ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২১
১ কেজি বাদাম ছিঁড়ে মেলে ৪ টাকা! শিশু সাদিয়া

পাবনা (ঈশ্বরদী): ‘বাবার কাজ নেই। সংসারে অভাব, এ কারণে চুলায় ঠিকমতো হাঁড়ি ওঠে না বলে 'সস্তা' শ্রমিক' হিসেবে বসে বসে বাদাম তুলছেন আট বছরের শিশু সাদিয়া।

 

পরিবারের অভাব পূরণ করতে ৮ ঘণ্টা কাজ করে তারা যে টাকাটা আয় করছে, এতে তাদের পরিবারে কিছুটা হলেও কাজে লাগছে। ’

বাদাম গাছের গোড়া থেকে এক কেজি বাদাম ছাড়ালে মেলে ৪ টাকা। সারাদিনে ৪০ কেজি বাদাম তুললে মেলে ১৫০ টাকা, আর এক মণ বাদাম কাটতে গেলে বেলা যায় গড়িয়ে। তবে পদ্মার চরে গিয়ে বাদাম তুললে জনপ্রতি ৩০০ টাকা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।  

শুক্রবার (১১ জুন) সকালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের ঝাউদিয়া পদ্মা নদীর চরে এ চিত্র দেখা যায়। তার সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা এই পেশায় নেমেছে। সাদিয়া, সাথী, তামান্না, সরল, সাজিদ, তামিম সবাই সাঁড়া ঝাউদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে তাদের।

জৈষ্ঠ্যের প্রচণ্ড খড়তাপে বসে উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের সাঁড়া ঝাউদিয়া বটতলায় বসে বসে গাছ থেকে বাদাম ছিঁড়তে দেখা যায় গ্রামের কয়েকজন শিশুদের। কথা হয় সাদিয়ার সঙ্গে।  

শিশু সাদিয়া বাংলানিউজকে জানায়, আব্বা নদীতে মাছ ধরে। এখন নদীতে পানি বেশি। আর অনেকদিনই করোনার জন্য স্কুলও বন্ধ। বাড়িতে বসে থাকি, তাই দাদির সঙ্গে এখানে কাজে এসেছি। এক কেজি বাদাম তুললে মেলে ৪ টাকা। সারাদিনে ২০ কেজি বাদাম ছিঁড়তে পারি। দাদি বড় মানুষ, তাই ৪০ কেজি বাদাম ছিঁড়তে পারে।  

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নে পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে থাকা ভাঙনকবলিত এলাকার পুরুষেরা মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। নদীর পানি বেশি তাই এখন মাছ নেই, পরিবারে অভাব-ঠিক সেই মুহূর্তে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে কোমলমতি শিশুদের 'সস্তা মজুরি' দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ক্ষেত মালিকরা শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নারী-শিশু শ্রমিককে দিয়ে কাজ করিয়ে নিলেও কেউ দেখার নেই।  

পদ্মার চর ঘুরে দেখা যায়, চরের জমিতে কেউ ক্ষেতের বাদাম কাটছেন। আবার নারী-পুরুষের পাশাপাশি কোমলমতি শিশু ছেলে ও মেয়েরা বাদাম তুলছেন। কেউ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।  

এদিকে পদ্মার চরে নারী ও শিশু শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পদ্মা পাড়ের মানুষের অভাব থাকায় সুবিধাভোগী গৃহস্থরা নারী, ছোট ছোট মেয়ে শিশুদের কাজে লাগিয়ে সারাদিনে ১৫০/৩০০ টাকায় কাজ করাচ্ছেন। অথচ একজন নারী শ্রমিক অন্য কাজ করে আয় করে সাড়ে ৫০০ টাকা।  

বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লে মানুষটিকে দেখে ঠিক যেনো বোঝা যায় না, আশি বছর ছুঁইছুঁই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুস ছাত্তার ভাণ্ডারী দুই সন্তানের জনক। বসতভিটা ছিল কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার চিলমারিতে। নদী ভাঙনের কবলে সব শেষ। চার মেয়ে দুই ছেলে। যুদ্ধের বছর আট বছরের ছেলে ও তিন বছরের মেয়ে মারা গেছে। এখন তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে-মেয়েরা ঘর সংসার করছেন। সহধর্মিণী ছবিরণ নেছার বয়স ৭০ তা দেখে বোঝার উপায় নাই। স্বামী-স্ত্রী দুইজনে বসে বসে বাদাম গাছের গোড়া থেকে বাদাম ছাড়াচ্ছেন।  

সাঁড়া ঝাউদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সরল (৮) বাংলানিউজকে জানায়, আমার আব্বা নদীতে মাছ ধরে। এখন নদীতে মাছ কম, মাছ পাওয়া যায় না। এই চরে বসে সারাদিন বাদাম তুলে দিলে ৩শ টাকা দেন গৃহস্থরা। স্কুল ছুটি তাই বাড়ির পাশে কাজ করছি। টাকা নিয়ে গিয়ে মায়ের হাতে দেয়।  
 
৭০ বছরের ছাহেরা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নদী ভাঙন এলাকার মানুষ বাবা, সারাদিন বসে থাকার চেয়ে ব্যাগার দেওয়া ভাল। বয়স্ক ভাতা পান কিনা? জানতে চাইলে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সরকার বয়স্ক ভাতা দিলেও আমাদের জোটেনি। এখানে আমাদের ভোটারই করা হয়নি।

ক্ষেতের মালিক সাঁড়ার ইসলামপাড়া গ্রামের গৃহস্থ আতিকুল ইসলাম আতিক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গ্রামের মানুষ। চরের মানুষ ছাড়া এই খড়তাপে অন্য এলাকার মানুষ কাজে আসে না। তাই এক মাসে বাদাম তোলার কাজে এলাকাবাসী কাজ করে থাকেন।  

সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান, এমদাদুল হক রানা সরদার বাংলানিউজকে জানান, নদী ভাঙন এলাকার মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে সাঁড়া ইউনিয়নে। পর্যায়ক্রমে তাদের ভোটার করে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতাসহ সব রকম সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যারা নতুন ও বাদ রয়েছেন, তাদের ভোটার ভাতা প্রদানের তো সুযোগ রয়েছেই। শিগগিরই এ ব্যবস্থা করা হবে।  

এছাড়া করোনার সময়ে স্কুলগুলো সব বন্ধ রয়েছে, যে কারণে পদ্মার চর এলাকার শিশুরা অনেকে কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ছে। শিশুরা যেন স্কুল বিমুখ না হয়, ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেন না বাড়ে, সাঁড়া ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অচিরেই স্কুলমূখী করতে মাইকিং করে সতর্ক একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানান ওই ইউপি চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২১
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।