ঢাকা: মাসুদ রানা এক সময় রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডের ব্যবসায়ী হাসান ইমামের গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি করতেন। গত প্রায় দুই মাস আগে তিনি চাকরি ছেড়ে সিরাজগঞ্জের একটি লুঙ্গি তৈরির কারখানায় গাড়ি চালকের চাকরি নেন।
এরই মধ্যে আগের মালিকের বাসায় লুটপাটের ফন্দি আঁটে মাসুদ রানার মনে। বিষয়টি ডাকাত বন্ধু মিজানুর রহমানকে জানিয়ে দুজনে পরিকল্পনা করেন। লুটপাটের উদ্দেশ্যেই গত ১০ জুলাই তারা দু’জনই ঢাকা আসেন। আশ্রয় নেন ওই বাড়ির দারোয়ান সুবল চন্দ্র পালের কক্ষে। ইয়াবা সেবনের পর গভীর রাতে লুটপাটের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে ঘুমন্ত সুবলের হাত-পা বাঁধতে গেলে শুরু হয় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি। এক পর্যায় কক্ষের ভেতরে থাকা একটি কাঁচি দিয়ে সুবলের গলায় চেপে ধরেন ঘাতক মাসুদ রানা। অপর পাশ দিয়ে নাইলনের দড়ি দিয়ে সুবলের গলা পেঁচিয়ে ধরেন।
প্রাণে বাঁচার জন্য সুবল মাসুদের হাতে কামড় দেন। এ সময় সুবলের গলার ডান পাশে ঢুকিয়ে দেন মাসুদ। এরপর দু’জনে সুবলের গলা টিপে ধরে হত্যা নিশ্চিত করেন।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে মাসুদ ও মিজানুর দুইজনই কক্ষের পাশে থাকা পানির কলে রক্ত ধুয়ে দারোয়ানের চাবি দিয়ে গেট ঘুলে পালিয়ে যান। বাড়ির দারোয়ান সুবলকে হত্যার পর ভেস্তে যায় তাদের লুটপাটের পরিকল্পনা।
গত ১১ জুলাই রাতে রাজধানীর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ১০ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ির দারোয়ান সুবল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরাসরি জড়িত দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। গ্রেফতার দুই আসামি হলেন- পরিকল্পনাকারী মাসুদ রানা (৩২) ও তার বন্ধু মিজানুর রহমান (২৬)।
হত্যাকাণ্ডের পর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) দুপুর ১২ টার দিকে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে সুবল হত্যা মামলায় সরাসরি জড়িত দুই আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। মূলত গ্রেফতার মাসুদ ও মিজানুর ওই বাড়ির মালিকের বাসায় লুটপাটের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। অভিযানে মাসুদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের সময় পরা জামা পুড়িয়ে দেওয়া অংশ এবং মাসুদের কাছ থেকে রক্তমাখা জামা উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি কাঁচি উদ্ধার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামিরা জানান, ওই বাড়ির দারোয়ান ও অন্যান্য সদস্যদের আটক ও জিম্মি করে মালামাল ও টাকা পয়সা লুটপাটের উদ্দেশ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন তারা। তাদের পরিকল্পনা ছিল গভীর রাতে দারায়ানকে হাত-পা বেঁধে জিম্মি করে বাড়ির মালিক যখন ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাবেন, ঠিক ওই সময় দরজা খুললে তারা ঘরে প্রবেশ করে বাড়ির সদস্যদের জিম্মি করে ফেলবেন। এরপর মালামাল লুট করে পালিয়ে যাবেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি মাসুদ রানা জানান, তিনি পেশায় গাড়ি চালক। আগে তিনি উত্তরা-৩ নম্বর সেক্টরের ওই বাড়ির মালিকের গাড়ি চালাতেন। গত দেড় মাস আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সিরাজগঞ্জের একটি লুঙ্গির কারখানার মাইক্রোবাসের চালক হিসেবে চাকরি নেন। এদিকে আসামি মিজানুর স্থানীয়ভাবে মাঝেমধ্যে অটো রিকশা চালাতেন। তবে তিনি পেশাগত ডাকাত দলের সদস্য। এর আগে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবরে ডাকতির প্রস্তুতিকালে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানা পুলিশ তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছিল।
ডিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, তদন্তে জানা গেছে, গ্রেফতার মাসুদ ওই বাসায় গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করতেন। তখন প্রতিনিয়ত তিনি ইয়াবা সেবন করতেন এবং নারী নিয়ে তার কক্ষে সময় কাটাতেন। বিষয়টি তখন দারোয়ান জানতেন। দারোয়ানের সঙ্গে মাসুদের ভালো সখ্যতার কারণে হত্যাকাণ্ডের আগের দিন মাসুদ দারায়ানকে জানান, তিনি ঢাকায় তার চাচাতো ভাইসহ এসে রাতে তার কক্ষে থাকবেন ও ইয়াবা সেবন করবেন। মাসুদ ও মিজানুর ১১ জুলাই রাত সাড়ে ১২টার দিকে সুবলের ঘরে প্রবেশ করেন। গেটটি দারোয়ানই খুলে দেন। পরে মাসুদ ও মিজানুর কক্ষে বসে ইয়াবা সেবন করেন। রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘুমন্ত দারোয়ানের হাত-পা বাঁধার উদ্দেশ্যে মাসুদ রানা বাইরে ঝুলন্ত কাপড় শুকানোর একটি নাইলনের রশি কেটে আনে। রশি দিয়ে তারা দারোয়ানের হাত-পা বাঁধতে গেলে তিনি জেগে যান। তখন মাসুদ ঘরের ভেতরে থাকা একটি কাঁচির ফলা তার গলায় ধরে তাকে চুপ থাকতে বলেন। মিজানুর তার গলায় নাইলনের রশি পেঁচিয়ে ধরলে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মাসুদ দারোয়ানের গলায় কাঁচির ফলাটি ঢুকিয়ে দেন। এতে রক্তক্ষরণ শুরু হলে মিজানুর ও মাসুদ উভয়ই তার গলায় কাঁচিটি পুরো ঢুকিয়ে দেন এবং গলা টিপে ধরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ সময় সুবলের মুখ চেপে ধরার কারণে সুবল তাদের হাতে কামড় দেন। হত্যার পর আসামিরা সুবলের হাত-পা ভালো করে বেঁধে ফেলে। এরপর দারোয়ানের রুমের বাইরের পানির কলে শরীর থেকে রক্তের ছাপ ধুয়ে ফেলেন এবং জামা ও কাপড় ধুয়ে রক্তের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, গ্রেফতারের পর আমরা দুই আসামির হাতেই কামড়ের দাগ দেখতে পাই। দারোয়ান সুবলকে হত্যার পর মাসুদ ও মিজানুরের লুটপাটের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তারা লুটপাট না করেই ওই বাসা থেকে পালিয় যান। ‘কঠোর লকডাউনের’ মধ্যেও তারা দু’জন বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহার করে সিরাজগঞ্জের নিজ গ্রামে চলে যান। আলামত গোপন করতে আসামি মাসুদ তার পরনের রক্ত মাখা শার্টটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
গ্রেফতার দুই আসামিকে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ১১ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ৩ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িতে সুবল চন্দ্র পাল (৪৪) নামে এক ব্যক্তি খুন হন। নিহত ব্যক্তির গলায় ক্ষত চিহ্ন এবং নাইলনের দড়ি দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। নিহত ব্যক্তি ওই বাসার দারোয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২১
এসজেএ/আরআইএস