খুলনা: খুলনার ব্যক্তিমালিকানাধীন বন্ধ জুটমিল পুনরায় চালু ও শ্রমিক কর্মচারীদের চূড়ান্ত পাওনা পরিশোধসহ ৬ দফা দাবিতে ফুঁসে উঠেছেন শ্রমিকরা। দাবি আদায়ে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ সমাবেশসহ আন্দোলন করছেন তারা।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শ্রমিকেরা। এমনকি শ্রমিক নেতারা খুলনায় শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানের বাড়ির সামনে অনশন করবেন বলেও জানিয়েছেন।
বন্ধ থাকা পাটকলগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফুলবাড়িগেট মিরেরডাঙ্গা এলাকার এ্যাজাক্স জুটমিল, শিরোমনি এলাকার মহসেন জুটমিল, শিরোমনি বিসিক এলাকার জুট স্পিনার্স, ট্রান্সওসেন ফাইবার্স, সোনালী ও আফিল জুটমিল।
শ্রমিকরা বলেন, একদিকে চাকরি নেই, বেতন নেই। অন্যদিকে করোনার এ সময়ে নতুন করে কোথাও কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। বেকার থাকায় আমাদের পরিবারে চলছে হাহাকার। অনেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া বেতন না পেয়ে রোগে শোকে বিনা চিকিৎসায় মারাও গেছেন।
অর্থঅভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণকারী মহসেন জুটমিলের শ্রমিক সৈয়দ আলীর ছেলে আশরাফ হোসেন টুটুল বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) বাংলানিউজকে বলেন, অর্থকষ্টে আমার বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। অথচ তিনি ৩৫ বছর চাকরি করে কোন টাকা পাননি। ২০১৪ সালে তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, পাটকল বন্ধক রেখে ব্যাংকের ঋণ নেওয়া এবং পরে সেই টাকা দিয়ে অন্য ব্যবসা পরিচালনা করা, মিল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সঠিক তদারকির অভাবে বন্ধ মিলগুলো চালু হচ্ছে না।
জানা যায়, মহসেন জুটমিলটি দীর্ঘ ১৩ মাস লে-অফ থাকার পর ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই বন্ধ ও মিলের ৬৬৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করে মিল কর্তৃপক্ষ। শ্রমিক কর্মচারীদের প্রায় ১০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সহ ৩ জনের নামে বকেয়া পাওনা আদায়ের জন্য বিভিন্ন ধারায় বিভাগীয় শ্রম পরিচালক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। যা চলমান রয়েছে।
এ্যাজাক্স জুটমিল ২০১৪ সালের ২২ মে মাসে বন্ধ হয়ে যায়। এ মিলের মালিক পক্ষের কাছে শ্রমিকদের প্রায় ২০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। মিলটিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় চার হাজার শ্রমিক ছিল। শ্রম পরিচালকের করা মামলায় এ্যাজাক্স জুট মিলের মূল মালিক বাবলার বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
সোনালী জুটমিলটি কয়েক দফা বন্ধের পর আংশিক চালু থাকলেও ২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর মিলটি পুনরায় বন্ধ হয়। মিলটিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক থাকলেও আংশিক চালু অবস্থায় ৭ শতাধিক শ্রমিক কাজ করতো। সোনালী মিলের মালিক এমদাদুল হক বুলবুল ও তার ছেলে মিলের এমডি শাওনের ৩ মাসের জেল হয়েছে। তারা উভয়েই পলাতক রয়েছেন।
এদিকে ট্রান্সওসেন ফাইবার্স মিলটি দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে বেকার রয়েছেন দু’শো থেকে আড়াইশো শ্রমিক।
আফিল জুটমিলের বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকায় ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর বিদ্যুৎ বিভাগ মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর ৪ মাস জেনারেটর দিয়ে মিলটি চালিয়ে রাখা হলেও ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মিলটি বন্ধ হয়। বর্তমানে শ্রমিকের মিল মালিকের কাছে প্রায় ৮ কোটি টাকা পাওনা ছিল । সেখান থেকে ২০২১ সালে দুই ঈদে ৮২১ জন শ্রমিক পেয়েছেন ১ হাজার টাকা। এসব শ্রমিক কোরবানীর ঈদে ৪০০ টাকা পেয়েছেন।
জুট স্পিনার্স মিলটি ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় মিলটিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করতো। এ মিলের মালিক পক্ষ থেকে শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। মিল মালিকের বিরুদ্ধে শ্রম পরিচালক ফৌজদারি অপরাধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। যা চলমান রয়েছে।
বেসরকারি পাট, সুতা, বস্ত্রকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথে সোচ্চার থাকলেও মালিক পক্ষের কাছ থেকে তেমন কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা।
বেসরকারি পাট, সুতা, বস্ত্রকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের প্রচার সম্পাদক সাইফুল্লাহ তারেক বাংলানিউজকে বলেন, সরকার নিজেকে শ্রম বান্ধব দাবি করে। আমরাও তা মনে করি। কিন্তু আমরা যখন আন্দোলন সংগ্রাম করে একটা পর্যায়ে চলে আসি ঠিক এই রকম সরকার দলীয় লোকজন যদি মনে করেন এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে কেন তারা প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানায় না। আমরা বিশ্বাস করি বিষয়টি যদি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে তাহলে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। মালিকরাতো পাটকল দেখিয়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিচ্ছে। কিন্তু যে কাজে খাটানোর কথা তা করছেন না। যে কারণে আমাদের রাজপথে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে।
বেসরকারি পাট, সুতা, বস্ত্রকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি শেখ আমজাদ হোসেন বলেন, মোট ৬টি পাটকলে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মানবেতর জীবনযাপন করতে করতে ৬টি জুটমিলে প্রায় সাড়ে ৩শ শ্রমিক মারা গেছেন। শুক্রবার জনসভা করে আমরা পরবর্তীতে মহানগরীর রেলিগেট এলাকায় শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানের বাড়ির সামনে অনশন করবো। রাজপথে আর যাবো না। রাজপথে গিয়ে আর মার খেতে পারবো না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন করবো। আমরা এত আন্দোলন করছি কিন্তু মালিক পক্ষ আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন না। তারা একবারে ডুব দিয়ে আছেন। মালিকপক্ষ ডিসির সঙ্গেও যোগাযোগ করে না। ডিসি মহোদয়ও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
খুলনা বিভাগীয় শ্রম পরিচালক মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা একাধিকবার সভা করেছি। মালিক পক্ষকে সময় দিয়েছি। কয়েকটি মিল মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছি। মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি একের পর এক ঠিক করার জন্য। কিন্তু মালিকদের না পেলে কি করবো। শ্রমিকরা সব জানে। তাদেরও একটু ধৈর্য ধরতে হবে। শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে আমরা তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২১
এমআরএম/এএটি