ঢাকা: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো খাতে, বিশেষ করে রেল, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, সড়ক পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নৌ-পরিবহন, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ করে আসছে ভারত। তবে ভারত সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে রেলখাতে।
রেলখাতের উন্নয়নে বর্তমানে ১৭টি নানা প্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ ১৯২ দশমিক ৮৯ কোটি ডলার। নতুন করে ত্রিপুরার দক্ষিণ জেলার বিলোনিয়া থেকে বাংলাদেশের ফেনীর মধ্যে দিয়ে রেলপথ সংযোগ স্থাপনে কাজ করছে ভারত সরকার। ইতোমধ্যে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার্স রেলওয়ে (এনএফআর) জমি জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। আগরতলা থেকে বাংলাদেশের আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে রেলপথ স্থাপনের কাজ চলার সময় বিলোনিয়া থেকে বাংলাদেশের ফেনীর মধ্যে দিয়ে রেলপথ সংযোগ স্থাপনের জমির জরিপ করা হয়। এ রেল সংযোগের ক্ষেত্রে বিলোনিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব হবে ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার। নতুর এ রুটে বিনিয়োগ করবে ভারত। ফলে শুধু রেলখাতেই ভারতীয় বিনিয়োগ ছাড়াবে দুই বিলয়ন ডলারের বেশি।
রেলপথ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, ভারতীয় বিনিয়োগে ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৯টি প্রকল্পের কাজ ইতোমধেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এছাড়া ২টি প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরির পর্যায়ে। তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান। বাকি তিনটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বানের কাজ চলমান।
২০১০ সালে প্রথম এলওসির আওতায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। ১৫টি প্রকল্পের আওতায় এ অর্থ দেওয়ার কথা ছিল। ২০১০ সালের ৭ আগস্ট ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ইআরডির ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়। পরে এই এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ থেকে ২০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। প্রথম এলওসিতে অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে আরও ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ দেয়।
বাংলাদেশের উন্নয়নে ৮৬ কোটি ডলার ভারতীয় ঋণের মধ্যে ৭০ কোটি ডলারই রেলখাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে। এই ঋণে ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি রেল সংক্রান্ত। ১৬৫ ব্রডগেজ (বিজি) ট্যাংক ওয়াগন সংক্রান্ত প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ১৬ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সব ক’টি ওয়াগন সরবরাহ করেছে ভারত। ১৭০ ফ্ল্যাট ওয়াগন সংক্রান্ত প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ১০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রেলে ভারতীয় ঋণে শেষ হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৮১টি বগি ট্যাংক ওয়াগন সংক্রান্ত প্রকল্প অন্যতম। এই প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ৭ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোট ব্যয় ১১ দশমিক ০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১০ লোকোমোটিভ সংক্রান্ত প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ৩১ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে সব ক’টি লোকোমোটিভ দেশে এসেছে।
প্রকিউরমেন্ট অব ১৬ লোকোমোটিভ প্রকল্পের আওতায় সবগুলো লোকোমোটিভ এসেছে। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ দশমিক ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ৫০ দশমিক ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া ৫০টি এমজি ফ্ল্যাট ওয়াগন ও ৫টি এমজি ভ্যান এয়ার ব্রেক কনটেনার সংগ্রহ প্রকল্পের কাজও শতভাগ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ৩ দশমিক ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
খুলনা থেকে মোংলা ব্রডগেজ রেললাইন ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। ধাপে ধাপে প্রকল্পের মোট ব্যয় বাড়ছে ২ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এই রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য মোংলা সমুদ্র বন্দরকে দেশের বিদ্যমান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং রেলপথে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন করা। এর মধ্যে সরকারি খাত থেকে আসবে ১ হাজার ১১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য থেকে আসবে ২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থ সংস্থানের লক্ষ্যে ভারতীয় ডলার ক্রেডিট লাইনের অর্থায়ন হিসেবে প্রথমে রেলপথ নির্মাণের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে এর মোট দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৮৫ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার।
১২০ বিজি কোচ সংগ্রহ প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে ভারতীয় ঋণ রয়েছে ৭৯ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারত বাংলাদেশের মধ্যকার পণ্য পরিবহন ও আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে ২০১০ সালে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সরকার। কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পে এতে ভারতীয় ঋণ রয়েছে ৭৮ দশমিক ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বন্ধ হওয়ার দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০১৮ সালে ১০ আগস্ট থেকে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। কাজের মেয়াদ ধরা হয় দুই বছর। এ প্রকল্পের আওতায় কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে শাহবাজপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার মেইন লাইন ও ৭ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার লুপ লাইন মিলে মোট ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপন করা হবে। ব্রডগেজ ও মিটার গেজের দ্বৈত লাইন ছাড়া রয়েছে ছয়টি স্টেশন এবং ৫৯টি সেতু কালভার্ট নির্মাণ।
ঢাকা-টঙ্গি রুটে তৃতীয় এবং চতুর্থ ডুয়েল গেজ ট্রাক নির্মাণ, ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে বিদ্যমান মিটার গেজ রেল লাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েল গেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ২৩৫ দশমিক ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আশুগঞ্জ-আখাউড়া রেলপথের সিগনালিং পদ্ধতি আধুনিকায়নের জন্যও ৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভারতীয় ঋণ দেওয়া হচ্ছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে। ‘কন্সট্রাকশন অব সেকেন্ড ভৈরব অ্যান্ড তিতাস রেল ব্রিজ উইথ অ্যাপ্রোচ রেল লিংক প্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগ ১০৭ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এছাড়া খুলনা-দর্শনা রেলওয়ে লিংক প্রকল্পে ৩১২ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলওয়ে লিংক প্রকল্পে ১২০ দশমিক ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। বগুড়া-শহীদ মনসুর আলী স্টেশন রেলওয়ে লিংক প্রকল্পে ৩৭৯ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ‘ক্যারেজ কন্স্রাটকশন রেলওয়ে ওয়ার্কশপ অ্যাট সৈয়দপুর প্রকল্পে ৭০ দশমিক ২৮ ও সৈয়দপুরে রেল অ্যান্ড রোড বেসড আইসিডি (অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো) নির্মাণ প্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগ ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া নতুন করে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর আবার চালু হয়েছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ। এরই মধ্যে বাংলাদেশের চিলাহাটি ও ভারতের হলদিবাড়ি স্টেশনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হয়েছে। রেলপথটি চালুর জন্য বাংলাদেশে চিলাহাটি থেকে সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার ও ভারতে হলদিবাড়ি থেকে সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার রেলপথ সংস্কার হয়েছে।
রেলপথের উন্নয়ন প্রসঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী গণমাধ্যমকে বলেন, রেলপথে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের রেলপথের উন্নয়নে ভারত সব সময় পাশে আছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ চালু হয়েছে। এবার ত্রিপুরার দক্ষিণ জেলার বিলোনিয়া থেকে বাংলাদেশের ফেনীর মধ্যে দিয়ে রেলপথ সংযোগ স্থাপনে কাজ করছে ভারত সরকার। রেলপথের উন্নয়নে উভয় দেশ লাভবান হবে। এমনকি ল্যান্ডলক দেশ নেপালেও রেলপথে পণ্য পরিবহন করতে পারবে বাংলাদেশ। কম সময়ে ও স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহনে রেলপথের তুলনা নেই। বাংলাদেশের রেলখাতের উন্নয়নে ১৭টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে ভারত। আমরা মনে করি এটা যথেষ্ট নয়, রেলপথের উন্নয়নে সামনে আরো উদ্যোগ নেওযা হবে।
করোনা রোগীর জন্য অতি প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী তরল মেডিক্যাল অক্সিজেনের (এলএমও) চালান নিয়ে ট্রেনটি ভারতের পেট্রাপোল হয়ে বেনাপোল বন্দর হয়ে স্বল্প সময়ে ও কম খরচে বাংলাদেশ পৌঁছায় বলে উদাহরণ দেন বিক্রম দোরাইস্বামী।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০২১
এমআইএস/এজে