ঢাকা, রবিবার, ২৬ মাঘ ১৪৩১, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘নব্য সাহেদ-সাবরিনা’ কাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

এ.কে.এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘নব্য সাহেদ-সাবরিনা’ কাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: রাকিব আলী ও তার তৃতীয় স্ত্রী মোসা. রেহেনা খাতুন। নিজেদের পরিচয় দেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের আত্মীয়, আবার কখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের নাতনী বা জেলা মহিলা লীগের সভাপতি আবার কখনো একজন আইনজীবী বা চিকিৎসক হিসেবে।

 

এসব রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে তারা সরকারি চাকরি ও বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার নাম করে বিপুল অংকের অর্থ আদায়, চেক জালিয়াতি, অন্যের আইডি কার্ড ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া, মসজিদের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি পুকুরের মাছ মেরে নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতি করছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এজন্য স্থানীয়রা তাদের নাম দিয়েছে ‘চাঁপাইয়া সাহেদ-সাবরিনা দম্পতি’।

অভিযোগ রয়েছে, তাদের এসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেই মামলা-হামলা ও ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া জঙ্গি ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে দমিয়ে রাখে চাঁদলাই গ্রামের শতাধিক পরিবারকে। প্রতারক এ দম্পতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের আতাহার-চাঁদলাই গ্রামের মো. গোলাম রাব্বানীর ছেলে ও তার তৃতীয় স্ত্রী।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেসবুকে রাকিবের ব্যক্তিগত আইডির টাইমলাইনেও দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রশংসা নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করতে। আর এসব ব্যবহার করেই ফায়দা নেওয়ার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি সংবাদটি প্রকাশ হলে প্রতিবেদকেও দেখে নেওয়ার হুমকি দেন রেহেনা খাতুন। দলীয় কোনো পদে না থাকলেও সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম করেন এই দম্পতি।

স্থানীয়রা জানায়, নিজেকে চিকিৎসক ও আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দেওয়া রাকিব-রেহেনা দম্পতি ৬-৭ বছর আগে জেলার শিবগঞ্জ থেকে চাঁদলাই গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, নার্সের চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর সেখান থেকে চলে আসেন এই দম্পতি। পরে ভুক্তভোগীদের মামলায় ৪ বছর আগে ৪০ দিন জেল খেটে জামিনে বের হয়ে আসেন রাকিব আলী। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়ের একটি আবাসিক হোটেলে নারী সরবরাহের কাজ করে থাকে রাকিব, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একবার পুলিশ তাকে আটকও করে।  

এলাকাবাসীর অভিযোগ, মাঝে মধ্যেই রাতের বেলায় মাইক্রোবাসে খদ্দের ও অচেনা নারীদের যাতায়াত করতে দেখা যায়। এমনকি রাকিব নিজের স্ত্রীকেও ব্যবহার করে এই অনৈতিক কাজে।

এ ব্যাপারে চাঁদলাই গ্রামের যুবক রজব আলী বাংলানিউজকে বলেন, ৮-১০টি পরিবারের কাছে সরকারি বরাদ্দের পানির পাম্প দেবে বলে বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়েছে। গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে জাহাঙ্গীরের কাছে ৩৮ হাজার, আফতাবের ছেলে মনিরুলের কাছে ২৭ হাজার, আজহারুলের কাছে ২৯ হাজার টাকা নিয়েছে রাকিব-রেহেনা দম্পতি। এছাড়া গ্রামের সহবুল, ময়না বেগম ও শফিকুলসহ আরো কয়েকজনের থেকে বিভিন্ন অংকের অর্থ নেওয়ার কথা বলেন রজব আলী।

একই এলাকার মো. রহমত আলী বাংলানিউজকে জানান, ১০ বছর আগে মৃত শরিফুল স্ত্রী শুকতারার কাছে ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে দেওয়ার নামে চেক জালিয়াতি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যান রাকিব। একই গ্রামের রেজাউলের স্ত্রী সুলতানার কাছে ত্রাণ দেওয়ার নাম করে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেন রাকিব। এই আইডি কার্ড ব্যবহার করে একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকার ঋণ নিলে ফেঁসে যান দিনমজুর রেজাউল। এমনকি করোনাকালে সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা বলে ৪০-৫০টি পরিবারের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে কিছুই দেননি রাকিব-রেহেনা দম্পতি।

দিনমজুর টুটুল আলী বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির নাম ভাঙিয়ে চলে স্বামী-স্ত্রী। এমনকি বিরাট বড় আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রী পরিচয় দেন তারা। আর এসব শুনে ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না।

রাকিবের চাচা মো. মনিরুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে জানান, গ্রামের চাঁদলাই জামে মসজিদের জমি দিয়েছিলেন তার বাবা মৃত আলফাজ উদ্দীন। কিন্তু মসজিদের কর্তৃত্ব তাকে না দিয়ে তার ভাতিজা তার মননীত ব্যক্তিকে সভাপতি করে মসজিদের কোটার টাকাও আত্মসাৎ করেছে। এক বছর আগে মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত ২ টন চাল নিজেরাই ভোগ করেছে। ২ বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ কাজ করার কথা বলে মসজিদের হিসাব থেকে নগদ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় যান রাকিব। তারপর মসজিদের কাজের কোনো খবর নেই।  

তিনি আরও বলেন, ৩ বছর আগে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান তসিকুল ইসলাম তসি মসজিদের সামনের ৩ বিঘার একটি সরকারি পুকুর মসজিদের নামে ইজারা দিলে জোরপূর্বক মাছ মেরে নেয় রাকিবের লোকজন। গত ১৫-১৬ দিন আগেও রাতের অন্ধকারে মাছ মারার সময় আব্দুল মালেক নামে এক ব্যক্তি নিষেধ করতে গেলে তার ওপর হামলা করে রাকিবের লোকজন। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ৪ দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি।

একই এলাকার শরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, মসজিদের ইমাম তাদের কথা মতো কাজ না করলেই তাকেও তাড়িয়ে দেয় রাকিব-রেহেনা। এমনকি ইমামদের জঙ্গি হিসেবে নাম দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিজেদের আজ্ঞাবহ করে রাখে তারা।

অভিযোগ রয়েছে, সাহেদ-সাবরিনাখ্যাত দম্পতির কাজে তাদের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন হামলা ও অপকর্মে কাজ করে রাকিবের চাচাতো ভাই খোকন, মামাতো ভাই আনারুল, ভাগ্নে আজিজুল, সবুজ, চাচা তরিকুলসহ আরো কয়েকজন।

এ বিষয়ে ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের ০৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, সরকারি পুকুর ও মসজিদ নিয়ে কয়েকবার সালিশ হলেও তা তারা মানে না। মেম্বার-চেয়ারম্যানকে কোনো পাত্তা দেয় না। সালিশে বসলেই বড় বড় নেতাদের দোহায় দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করে।

আর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. তসিকুল ইসলাম তসি বাংলানিউজকে বলেন, ঝিলিম ইউনিয়নে চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে রাকিবকে বিআরডিবিতে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। পরে সেখানে চাকরিরত অবস্থায় সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে ঢাকায় পালিয়ে যায় রাকিব। আবার নিজ এলাকায় ফিরে এসে লোকজনের কাছে বিভিন্ন সরকারি চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল অংকের টাকা নেয়।  

তিনি আরও জানান, রেহেনায় হলো রাকিবের চালক। মসজিদের জন্য সরকারি পুকুর ইজারা করে দিয়েছিলাম, সেটিও দখল করে ভোগ করছে রাকিব ও তার লোকজন। তাদের এমন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী।

তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রেহেনা খাতুন। একজন সমাজসেবক পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, আমাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মানহানি করতেই এমন অভিযোগ করা হয়েছে। এসময় তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে নিজেকে সদর উপজেলা মহিলালীগের পূর্বের কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। এছাড়া তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে সাংবাদিকের পায়ের নিচের মাটি থাকবে না বলে হুমকি দেন।

অপর অভিযুক্ত রাকিব আলীকে বাড়িতে না পেয়ে তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।