ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

কার ভাতা কে খায়? -২

মৃত ব্যক্তির ভাতা যায় চেয়ারম্যানের নম্বরে!

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২১
মৃত ব্যক্তির ভাতা যায় চেয়ারম্যানের নম্বরে!

লালমনিরহাট: সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় ভাতা বিতরণে  ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সেই অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ রইলো দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

জানা গেছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্পের মাধ্যমে বয়স্ক ও বিধবাদের জনপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা এবং অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ৭৫০ টাকা ভাতা দিচ্ছে সরকার।

শুরুতে মাসিক ভাতার এ  টাকা সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হলেও সাম্প্রতি ভোগান্তি এড়াতে অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অনলাইনের সুযোগে কতিপয় অসাধু ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান সুফলভোগীর নম্বরের পরিবর্তে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নম্বর দেন। ফলে সুফলভোগীদের অর্থ চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের দখলে। মৃত ব্যক্তির নামের টাকাও নিচ্ছেন কেউ কেউ।

গত ৬/৭ মাস আগে মারা যান মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া দোড়ার ব্রিজ এলাকার আলু ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমানের মা বয়স্কভাতা ভোগী হাজরা খাতুন। এর পরেও গত জুন মাসে দুই দফায় তাকে বিকাশে ৪ হাজার ৫১০ টাকা দেওয়া হয়। তবে এ টাকা চলে যায় ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরীর ব্যাক্তিগত ০১৭১২৮৫৫৮৮৫ নম্বরে। ইউনিয়ন পরিষদের চাহিদায় পাঠানো  বিকাশ নম্বরটি পরিবর্তন করে চেয়ারম্যানের নম্বর দেওয়া হয়েছে। ফলে পাসবুক তথ্যানুযায়ী মৃত হাজরা খাতুনের টাকা পাচ্ছেন ইউপি চেয়ারম্যান।

 

হাজরার পুত্রবধূ সাবিনা বেগম বলেন, আমার শ্বাশুড়ি ৬/৭ মাস আগে মারা গেছেন। এরপরও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিকাশ নম্বর চাইলে আমরা দিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত টাকা পাইনি।

অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, এ নম্বরটি এখন ব্যবহার করি না। তাই টাকা এসেছে কি না জানা নেই। নম্বরটি বিকাশ করাও ছিল না। সিমটি অনেকদিন আগে ফেলে দিয়ে নতুন সিম ব্যবহার করছি।

উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের সবদল বুড়িরঝাড় গ্রামের নবির হোসেনের স্ত্রী আলীমন নেছা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন কয়েক বছর ধরে। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার কাছে বিকাশ নম্বর চাইলে ০১৭৮৭৭০২৩০১ নম্বরটি ইউপি সদস্যের মাধ্যমে পাঠানো হয়। কিন্তু তার নম্বর পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম প্রধানের ব্যক্তিগত ০১৭১০৮৭০২৪৪ নম্বরটি। সেই নম্বরে আলীমন নেছার বয়স্কভাতার ৫০৩ টাকা গত ১২ জুন রাত ১১টায় ৫০ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে পাঠানো হয়েছে বলে পাসবুক তথ্যে জানা গেছে।

এদিকে ভাতার টাকা না পেয়ে অতিদরিদ্র আলীমন নেছা ওষুধ তো দূরের কথা, খাবারও কিনতে পারছেন না।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সাঈদ মেম্বর বিকাশ নম্বর চেয়েছিল, দিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো টাকা পাইনি। চেয়ারম্যান বলেছে অফিসের লোকজন নাকি মোবাইলে আমার টাকা মেরে দিয়েছে।

তবে, অভিযুক্ত সারপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, নম্বরটি আমার, কিন্তু বিকাশ করা নেই এবং টাকাও আসেনি। ইউনিয়নের অসংখ্য ব্যক্তি এখনও ভাতা পায়নি বলে দাবি করেন তিনি।

একই গ্রামের প্রতিবন্ধী আব্দুর রহমানের ভাতার জন্য ০১৩০৬১৩৩৫৮২ নম্বর দেওয়া হলেও গত ২৬ জুন তার ভাতা বাবদ ৬ হাজার ৭৯৭ টাকা চলে যায় ০১৪০৫৫৪১৩৪৬ নম্বরে। আর এ নম্বরটি ওই ইউপি সদস্য সাঈদের বলে জানান সরকারি একটি দফতর। দীর্ঘ ৭/৮ মাস ধরে টাকা না পেয়ে চিকিৎসা করতে পারছেন না আব্দুর রহমান।

এদিকে ইউপি সদস্য সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, এটি আমার নম্বর নয়। প্রতিবন্ধী আব্দুর রহমানের ভাতার তালিকায় নম্বরটি দেখেছি।

মহিষখোচা ইউপি সদস্য শাহেরবানু ও তার স্বামী সাবেক গ্রাম পুলিশ আজিজুর রহমান উভয়ে সুস্থ থাকলেও ক্ষমতার প্রভাবে দু'জনেই পাচ্ছেন অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা। আজিজুর রহমান বলেন, আমার স্ত্রী ধবল রোগী, আর আমি ডায়াবেটিস রোগী। তাই সমাজকল্যাণ মন্ত্রীকে বলে ভাতাটা করে নিয়েছি।

এভাবে পুরো উপজেলার সুফলভোগীদের নামের অনুকূলে ৩২জন ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত নম্বর রয়েছে বলে  বাংলানিউজের কাছে তথ্য রয়েছে। অনেক ইউপি সদস্য ও সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা নিজের ও পরিবারের একাধিক সুস্থ-সবল লোকের নামেও অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগ করছেন।

এছাড়াও ইউপি সদস্যদের অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নামে রেজিস্ট্রি করা সিম দিয়েও সুবিধাভোগীদের ভাতা উঠিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যা সুষ্ঠু তদন্ত করলে ধরা পড়বে।

এদিকে ভুক্তভোগীরা তাদের নামের অনুকূলে ব্যবহৃত বিকাশ নম্বরগুলো কোন জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে তা দ্রুত তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার রওশন আলী মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, ভাতাভোগীর নম্বর পরিবর্তন করে যারা নিজের বা পরিবারের নম্বর দিয়ে টাকা নিয়েছেন তারা যেই হন, তদন্ত করে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩ , ২০২১
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।