ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কাভার্ডভ্যানে মরদেহ নিয়েই পণ্য সরবরাহ করে ঘাতকরা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১
কাভার্ডভ্যানে মরদেহ নিয়েই পণ্য সরবরাহ করে ঘাতকরা

ঢাকা: একটি সিগারেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন মো. জুয়েল রানা (২৯)। দোকানে মালামাল সাপ্লাইয়ের সুবাদে একটি দুধ বিপননকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি মিরাজের সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল।

 দোকানে মালামাল সাপ্লাই দেওয়া ও বিল তোলার কারণে সব সময় জুয়েলের কাছে নগদ টাকা থাকতো। বিষয়টি মিরাজ জানতো। আর এ টাকা হাতিয়ে নিতে দুই সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে জুয়েলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে মিরাজ।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে প্রথমে জুয়েলকে ইয়াবা সেবন করায়, এরপর শ্বাসরোধ করে হত্যার পর একটি ড্রামে লাশ ভরে রাখে। নিহত জুয়েলের কোম্পানির কাভার্ডভ্যানেই জুয়েলের লাশ নিয়ে গাবতলী থেকে মিরপুরে কয়েক জায়গায় মিরাজ তার কোম্পানির দুধ (পণ্য) সাপ্লাই দেয়। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুরের লাভ রোডের পাশে মরদেহভর্তি ড্রামটি ফেলে পালিয়ে যায় মিরাজ ও তার দুই সহযোগী।

ওইদিন রাত ২টার দিকে স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে ড্রামে অজ্ঞাত পরিচয়ের একটি মরদেহ উদ্ধার করে মিরপুর থানা পুলিশ। সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে লাশটি পাঠানো হয়। তদন্ত শুরু করে পুলিশ। নিহতের গায়ে থাকা টি-শার্টে লেখা একটি স্লোগানের (‘সাফল্যের পথে একসাথে’) সূত্র ধরে নিহতের নাম-পরিচয় উদঘাটন ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে পুলিশ।

রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৫টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের ডিসি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ক্লু-লেস এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের বিষয় জানিয়েছেন উপ-কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহতাব উদ্দিন।

তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের পর আমরা নিহতের ফ্রিঙ্গার প্রিন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও নিহতের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তবে নিহতের গায়ে থাকা গেঞ্জিতে লেখা থাকা একটি স্লোগান (সাফল্যের পথে একসাথে) দেখে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। আমরা জানতে পারি, ওই স্লোগান সম্বলিত গেঞ্জিটি তামাক কোম্পানির। ওই কোম্পানির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিহতের ছবি দেখিয়ে তার পরিচয় জানতে পারি।  

তারা জানায়, মো. জুয়েল রানার বাড়ি বরিশালের ভোলা সদরে। পরে নিহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ছবি দেখে জুয়েলকে শনাক্ত করে। খবর পেয়ে নিহতের স্ত্রী মোসা. সালমা আক্তার (২২) ভোলা থেকো ঢাকা আসেন। পরদিন (১৮ সেপ্টেম্বর) তিনি মিরপুর মডেল থানায় বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিন আসামিকে আমরা গ্রেফতার করেছি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামীরা জানায় পরিকল্পিতভাবে জুয়েলকে তারা হত্যা করেছে।

গ্রেফতার তিন:
মিরপুর বিভাগের ডিসি আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবে মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. খোকন মিয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে আশেপাশে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সেখানে জড়িতদের শনাক্ত করে নাম-পরিচয় খুঁজে বের করা হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দারুস সালাম থানাধীন গৈদারটেক এলাকা থেকে মো. মিরাজকে (১৮) গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে নিহত জুয়েলের কোম্পানির সিগারেট বিক্রির নগদ ৩৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

মিরাজের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিরপুর সেকশন-২ এর এফ ব্লকের ১ নং রোডের ১৪ নং বাসা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত সিলভার রংয়ের কাভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্রো ম-৫১-৪৭৯৫) জুয়েল রানার ছবি সম্বলিত সিগারেট কোম্পানির আইডি কার্ড, চার কার্টুন সিগারেট জব্দ করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পল্লবী থানাধীন সেকশন-১১ কাঁচা বাজার এলাকা থেকে হত্যার ঘটনায় জড়িত অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণকে (১৫) গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে সিগারেট বিক্রির নগদ ৭ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে দুই আসামির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. রাসেলকে (২০) গ্রেফতার করা হয়।

আসামিদের পরিচয়:
মিরাজ রাজবাড়ীর কালুখালীর মো. রওশন মণ্ডলের ছেলে। অপর আসামি, মো. রাসেল (২০) বরিশাল হিজলার কায়েসমা (রাঢ়ী বাড়ী) এলাকার আব্দুল সত্তারের ছেলে। এছাড়াও অপ্রাপ্ত বয়স্ক একজন কিশোর রয়েছেন।

হত্যার ছক কষে রাসেল:
ডিসি আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে আসামিরা জানায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে মো. রাসেল (১৯) ও আরেকজনকে (অপ্রাপ্ত বয়স্ক বয়স ১৫) সঙ্গে নিয়ে প্রথমে গাবতলীতে যায়। তারা একটি কাভার্ডভ্যানে উঠে এবং সেখানে ইয়াবা সেবন করে। মিরাজ ওইদিন রাত ১০টার দিকে জুয়েলকে ডেকে এনে কাভার্ডভ্যানে তোলে। সেখানে জুয়েলকেও ইয়াবা সেবন করায় তারা।

জুয়েল নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে এক পর্যায়ে তার মুখ চেপে ধরে মিরাজ। এদিকে, মিরাজের সহযোগীরা জুয়েলের গলায় রশি দিয়ে পেচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে দেয়। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে জুয়েলকে নির্মমভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে কাভার্ডভ্যানে আগে থেকেই এনে রাখা একটি ড্রামের ভেতরে জুয়েলের লাশ ভরে রাখে।

ওই কাভার্ডভ্যানে এভাবেই জুয়েলের লাশ নিয়ে গাবতলী থেকে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে মিরাজ তার প্রতিষ্ঠানের দুধ (পণ্য) ডেলিভারিও দেয়। সুযোগ বুঝে রাত সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর লাভ রোডের পাশে রাস্তায় ড্রামসহ জুয়েলের লাশ ফেলে পালিয়ে যায়।

কেনো জুয়েলকে হত্যা করা হয়:
মিরপুর বিভাগের উপ কমিশনার ডিসি আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, টাকার বিশেষ প্রয়োজন ছিল মিরাজের। সে টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে রাসেলকে জানায়। মূলত: রাসেলের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় জুয়েলকে হত্যার ছক আঁকে তারা।

তিনি বলেন, সিগারেট কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করায় জুয়েলের কাছে বিক্রয় বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা মজুদ থাকে এটা জানতে মিরাজ। মূলত: তিনজন মিলে ওই টাকাটা হাতিয়ে নিতেই হত্যার পরিকল্পনা করে।

রাসেলের পরিকল্পনা মোতাবেক মিরাজ ও রাসেল প্রথমে একটি ড্রাম ক্রয় করে। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে গাবতলীতে জুয়েলকে আসতে বলে। জুয়েল ঘটনাস্থলে আসলে তিনজন মিলে ইয়াবা সেবন করে। তিন দফা ইয়াবা সেবনের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় রাসেলও। তিনজন মিলে কাভার্ডভ্যানের ভেতরে বসে পেছন থেকেই রশি দিয়ে জুয়েল রানাকে গলায়সহ নাকমুখ পেঁচিয়ে ফেলে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মেরাজ পা-মুখ চেপে ও শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে নিহত জুয়েলের কাছে থাকা কোম্পানির মালামাল বিক্রির ৭৬ হাজার টাকা ভাগ করে নেয় ঘাতকরা।

বাংলাদেশ সময়: ০০১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১
এসজেএ/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।