ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মাঘ ১৪৩১, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

প্রযুক্তিতেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২১
প্রযুক্তিতেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদক প্রতীকী ছবি।

ঢাকা: কোনো ধরনের মাদকদ্রব্যের উৎপত্তিস্থল না হওয়া সত্ত্বেও মাদকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। পুরনো প্রচলিত মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি হাল আমলের ভয়াবহ মাদক আইস কিংবা এলএসডির (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড) প্রচলন দেখা যাচ্ছে দেশে।

নানা পন্থায় বিভিন্ন দেশ থেকে ঢুকছে এসব মাদক, যার বেশিরভাগই আসছে পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত পার হয়ে।

মাদক নিয়ন্ত্রণে দেশের ভেতরে ও সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসব কারণে কোনো এলাকায় মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। এমনকি সীমান্তে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ভেদ করে কৌশলে ঢুকে পড়ছে মাদক।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানায়, সীমান্তে সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর যশোর বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তে স্থাপন করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ‘স্মার্ট বর্ডার সার্ভিল্যান্স সিস্টেম (এসবিএসএস)’। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্তের প্রায় নয় কিলোমিটার এলাকায় এসবিএসএস প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়। এর ফলে ওই এলাকা হয়ে কোনো মানুষ, প্রাণী বা মাদক অতিক্রম করলেই খবর চলে যাচ্ছে বিজিবির কাছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসবিএসএস প্রযুক্তির সহায়তায় মাদক চোরাচালান কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে একেবারে বন্ধ করা যায়নি। সীমান্ত এলাকায় অনেক বাড়ি রয়েছে। এছাড়া অনেক এলাকায় আখচাষসহ উঁচুজাতের বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হয়েছে। এর ফলে কোনো চোরাকারবারী সীমান্ত অতিক্রম করলে এসবিএসএস সিস্টেমের মাধ্যমে বিজিবি সিগন্যাল পায় ঠিকই, কিন্তু নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাতেই সেসব বাড়ি বা আখের জমি হয়ে পালিয়ে যায় তারা।

বিজিবি সূত্র জানায়, পুটখালীতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর রয়েছে ইছামতি নদী। বর্তমানে এ নদীর তীর ধরে প্রায় নয় কিলোমিটার এলাকা এসবিএসএস সিস্টেমের আওতায়। এর ফলে ইছামতির দুই পাড় বিজিবির সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে। এর মাধ্যমে যথাসময়ে নির্ধারিত স্থান শনাক্ত করে স্পষ্ট হওয়া যাচ্ছে যে কোনো বিষয়। প্রয়োজনে দ্রুত সময়ে সেসব স্থানে পৌঁছে যেতে পারেন বিজিবি সদস্যরা।

বেনাপোল সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ও মাদক ঠেকাতে এসবিএসএস প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর ফলে টাওয়ারে বসানো থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা এবং লং রেঞ্জ ক্যামেরার মাধ্যমে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা, এমনকি ঘন কুয়াশার মধ্যেও তৎক্ষণিক ছবি বা ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে।

 

ছবি: বাংলানিউজ

 

যেভাবে কাজ করে এসবিএসএস

বিজিবির সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী এ সিস্টেমের ৪৬.৫ মিটার বা প্রায় ১৫৩ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন একটি প্রধান টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ারের ওপরে অত্যাধুনিক দুটি ডিজিটাল ক্যামেরা রয়েছে। যার একটি লং রেঞ্জ ক্যামেরা, যা দিনের বেলায় কাজ করে। অন্যটি থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা, যা রাতের বেলায় অথবা ঘন কুয়াশার মধ্যে কাজ করে।

এসবিএসএস’র সহায়ক হিসেবে সীমান্তের দীর্ঘ নয় কিলোমিটার এলাকায় ১৯টি রিপিটার পোল রয়েছে। এক পোল থেকে আরেকটি পোলের দূরত্ব ৫০০ মিটার। প্রত্যেক রিপিটার পোলে দুটি করে ডিভাইস লাগানো রয়েছে। একটি পোল থেকে আরেকটি পোলে কানেকটিং ক্যাবলের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। মাটির নিচ দিয়ে স্থাপন করা ওই ক্যাবলটি সেন্সরবিশিষ্ট।

সীমান্তের যে কোনো স্থান দিয়ে কোনো মানুষ, প্রাণী বা পণ্য অতিক্রম করলেই তাৎক্ষণিকভাবে ওই সেন্সর ক্যাবলের মাধ্যমে কম্পনের সৃষ্টি হয়। কম্পনটি পোলে থাকা ডিভাইসে রিসিভ হয়ে শক্তিশালী একটি সিগন্যালে পরিণত হয়। এরপর সিগন্যালটি পোল থেকে এন্টেনার মাধ্যমে প্রধান টাওয়ারে যায়। টাওয়ারের ওপরে এসবিএসএম নামে একটি ডিজিটাল ডিভাইস রয়েছে, যা রিপিটার পোল থেকে সিগন্যাল রিসিভ করে।

সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই সেটি কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটারে ভেসে ওঠে। তখন কম্পিউটারে দেখা যায়- ১৯টি পোলের কোন পোল থেকে সিগন্যালটি এসেছে এবং টাওয়ারের ক্যামেরা তখন ওই পোলে ফোকাস করতে থাকে। সন্দেহজনক কিছু ক্যামেরায় দেখতে পেলে কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়্যারলেসে বিজিবির নির্ধারিত ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবগত করা হয়। এরপর বিজিবি সদস্যরা ওই পোলের এলাকা তল্লাশি করে দেখেন।

এসবিএসএস’র জন্য যশোর সীমান্তে বিজিবি এবং বিএসএফের দুটি বিওপির (দৌলতপুর ও কল্যাণী) দায়িত্বপূর্ণ আট দশমিক তিন কিলোমিটার এলাকাকে অপরাধমুক্ত হিসেবে ষোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ঘোষণায় ওই এলাকায় সীমান্ত অপরাধসহ চোরাচালান কমানো সম্ভব হয়েছে।

 

ছবি: বাংলানিউজ

 

এসবিএসএস’র চ্যালেঞ্জ

সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন এই সিস্টেমের আওতায় সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সার্বক্ষণিক নজরদারি অনেকটা সহজ হয়েছে। আরেকদিকে সিগন্যাল অনুযায়ী সার্বক্ষণিক কাজ করায় ওই এলাকার বিজিবি সদস্যদের দায়িত্ব বেড়েছে কয়েকগুণ। টানা এই নজরদারির পরেও ওই এলাকা হয়ে মাদক ও চোরাচালান একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ সীমান্ত ঘেঁষে কিছু বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। কোনো চোরাকারবারী সীমান্ত অতিক্রম করে সেসব বাড়িতে ঢুকে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্থানীয়রা এমনিতেই ইছামতি নদীর তীরে বসে আছেন। দেখে বুঝার উপায় নেই তিনি চোরাকারবারী। নদীটি খুবই ছোট হওয়ায় সময়-সুযোগমতো পার হয়ে দ্রুত মাদকসহ অন্যান্য চোরাইমাল নিয়ে আসা যায়। চোরাকারবারীদের প্রায় সবার কাছেই ওপারে যোগাযোগের জন্য সে দেশের সিম রয়েছে।

এছাড়া, সীমান্ত এলাকায় স্থানীয়দের সহায়তায় চোরাকারবারীরা আখচাষসহ অন্যান্য উঁচু জাতের গাছ রোপণ করেছে। চোরাকারবারীরা সীমান্ত অতিক্রম করেই সেসব আখের জমি বা গাছের বাগানের মধ্যে ঢুকে যায়। এর ফলে সিস্টেমে সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা নির্ধারিত স্থানে ফোকাস করলেও কিছু খুঁজে পায় না। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও নতুন এই সিস্টেমের ফলে সীমান্তঅপরাধ অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজিবি যশোরের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন ভূঞা বলেন, স্পর্শকাতর এলাকায় বিজিবির নজরদারি নিশ্চিত করতে স্মার্ট বর্ডার সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম (এসবিএসএস) কাজ করছে। এর মাধ্যমে সীমান্তে সংশ্লিষ্ট কমান্ড পর্যায় থেকে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে। নতুন এই সিস্টেম মাদক, অস্ত্রসহ সব ধরনের চোরাচালান ও সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধে সহায়তা করছে।

 

ছবি: বাংলানিউজ

 

পতিত খাটাল, জমজমাট ফেনসিডিলের কারবার

সম্প্রতি সরেজমিনে জানা যায়, ভারতীয় গরুর চালানের একটি বড় অংশ দেশে ঢুকতো যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে। প্রায় প্রতিদিন এই সীমান্ত দিয়ে দুই-তিন হাজার গরু দেশে ঢুকতো। আর সেসব গরু সীমান্তের এপারে এনে রাখার স্থানকে বলা হয় খাটাল। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন আর গরু আসে না। ফলে পতিত হয়ে পড়ে আছে সেইসব খাটাল। তবে এই এলাকায় এখন ফেনসিডিলের রমরমা কারবার চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে যারা গরু ব্যবসায়ী ছিলেন, তারাই এখন মাদকের কারবারে নেমেছেন। বেনাপোলের পুটখালী, দৌলতপুর গোগা ও তেরোঘর সীমান্ত দিয়ে এসব ভারতীয় মাদক দেশে আসে। মাদক ব্যবসায় জড়িত অনেকেই রাতারাতি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক বনে গেছেন। ফলে কয়েকবছর আগে সীমান্ত এলাকার কাঁচা বাড়ি এখন অধিকাংশই পাকা হয়ে গেছে।

বিজিবির দাবি, সীমান্তে নিয়মিত টহল, আধুনিক ক্যামেরা স্থাপন ও সচেতনতার কারণে মাদকের চালানের পরিমাণ কমে গেছে। তবে শূন্যের কোঠায় এখনো আসেনি। প্রায় প্রতিদিনই বিজিবি মাদকের চালান জব্দ করছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২১
পিএম/এনএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।