ঢাকা: দারিদ্রতার বেড়াজালে টানাটানির সংসার চালাতে দিনমজুরের কাজ করেন বাবা। আর মাও মাঝে-মধ্যে কাজ করেন অন্যের খামারে।
প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় তানহা মায়ের কাছে ১০ টাকা চেয়েছিল। টাকা দেওয়া হয়নি, উল্টো ধমক দিয়ে প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য বলেন মা। কে জানতো তানহার এই যাওয়া হবে একেবারে নিখোঁজ হওয়া?
সেই সকাল থেকে এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৬ মাস। চার দিকে খোঁজাখুঁজি, থানা পুলিশ করেও আর হদিস পাওয়া যায়নি শিশু তানহার।
থানা পুলিশের হাত ঘুরে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে যাওয়ারও প্রায় চার মাস হতে চললো। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ভাষ্য ‘হদিস মিলছেনা তানহার’। এ অবস্থায় কোথায়-কার কাছে যাবেন বুঝে উঠতে পারছে না পরিবার। ‘দিন-দুপুরে আমার মেয়ে কি হাওয়া হয়ে গেল’-এই উত্তর কার কাছে খুঁজবেন অসহায় মা পারুল বেগম?
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আড়াকুল এলাকার বাসিন্দা ডালিম-পারুল দম্পতির বড় মেয়ে তানহা স্থানীয় স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পাশের বাড়ির একজন শিক্ষিকার কাছে প্রাইভেট পড়তে দিয়েছিলেন তানহাকে। ১৯ এপ্রিল সকালে তানহা প্রাইভেট পড়তে বের হয়। কিন্তু তার খোঁজ করার পর জানা যায়, সেদিন তানহা প্রাইভেট পড়তে যায়নি। তাহলে নিজের বাড়ি থেকে পাশের বাড়ি যাওয়ার পথেই কি নিখোঁজ হয় তানহা?
পারুল বেগম বলেন, টিচারের বাসায় না পেয়ে, এরপর আশে-পাশে খোঁজাখোঁজি শেষে এলাকায় মাইকিংও করা হয়। সাম্ভাব্য আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি খোঁজ নিয়ে পরদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং- ৯৫২) লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর ঘটনার কোন কূল-কিনারা করতে না পেরে ২৬ এপ্রিল অজ্ঞাতনামা কেউ তানহাকে অপহরণ করেছে বলে থানায় একটি মামলা (নং-৬০) দায়ের করেন তিনি।
সন্দেহে প্রতিবেশী আছিয়া
পারুল বেগম-ডালিম দম্পতির পাশের বাড়িতেই বসবাস করেন আছিয়া-সাত্তার দম্পতি। আছিয়ার বোনের মেয়ে নিঃসন্তান এবং তাকে কোথাও থেকে সন্তান এনে দেওয়ার কথা বলেছিলেন খালা আছিয়াকে। টাকার বিনিময়ে হলেও তিনি সন্তান চাইতেন। বিষয়টি আছিয়া প্রায়ই প্রতিবেশী হিসেবে পারুল বেগমের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
মামলার এজাহারেও পারুল বেগম উল্লেখ করেন, তানহা নিখোঁজের পর লোকমুখে জানতে পারেন, তার বাসা থেকে আনুমানিক ২০০ গজ উত্তরের রাস্তা থেকে অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীরা তানহাকে অপহরণ করে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখেছে। তার ধারণা, আছিয়া ও সহযোগিরা তানহাকে অসৎ উদ্দেশ্যে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
এছাড়া, তানহা হারিয়ে যাওয়ার দিন বিষয়টি নিয়ে আছিয়া-সাত্তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলেও শুনেছেন অন্য প্রতিবেশীরা। ঘটনাটি তদন্তে নেমে থানা পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার দিন গভীর রাত পর্যন্ত আছিয়া একটি ফোন নাম্বারে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন। পরে তিন চারদিন পর সন্দেহভাজন আছিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
একমাস জেল খেটে জামিনে আছিয়া
তদন্তের ধারাবাহিকতায় আছিয়াকে গ্রেফতারের পর প্রায় এক মাস তিনি জেল খাটেন, তবে বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। ১৪ সেপ্টেম্বর মামলায় আসামিপক্ষের হাজিরার দিন বাদিপক্ষের আইনজীবী তার জামিন বাতিলের আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এদিনই আইনজীবী জানতে পারেন আছিয়া উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।
নিখোঁজ তানহার নানা ইমাম হোসেন বলেন, নাতনিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে যেখানে বলছে সেখানেই গেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে জিডি করলাম, মামলা করলাম, উকিল ধরলাম। মামলা সিআইডিতে যাওয়ার পর কয়েকবার সেখানেও গেছি। কিন্তু কোনো কিছুতেই নাতনির খোঁজ পাইতেছি না। আর কই যামু আমরা...
আলোচনার ফাঁকে মা পারুল বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন, আমার এতো বড় মেয়েতো বাড়ি থেকে বের হয়েই হাওয়া হয়ে যায় নাই। এতোগুলা মাস গেছে, এখনো তার হদিস পাইলাম না। জানি না মেয়েটা কই আছে, কেমন আছে দয়া কইরা আমার মেয়েটারে খুঁজে দেন।
অন্ধকারে সিআইডি
ভিকটিম পরিরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশে মামলাটি ১৩ জুন সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ চার মাস পার হতে চললেও তানহা নিখোঁজের কোরো কূল-কিনারা করতে পারেনি সিআইডি।
বর্তমানে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এখনো নিখোঁজ শিশু তানহার খোঁজ পাচ্ছি না। তার নিখোঁজের কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না, বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি।
আমরা সন্দেহভাজন ওই নারীকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। ওই নারীর সঙ্গে অন্যান্য যেসব স্বজনদের বিষয়টি আলোচনায় আসছে, তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদেরকেও প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২১
পিএম/এসআইএস