কুমিল্লা: প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রথমে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। তারপর টাকা আত্মসাত করেন।
দুই নারীকে একই কায়দায় হত্যার পাশাপাশি আরও দুইজনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তার। এক মাসের ব্যবধানে দুই হত্যাকাণ্ড ঘটান তিনি।
মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কুমিল্লার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান এসব তথ্য জানান।
জানা যায়, জেলার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদুল্লার ছেলে মুন্না মা মারা যাওয়ার পর থেকে কখনো কারো পালিত সন্তান হিসেবে আবার কোথাও কাজের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সর্বশেষ কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে বয়ের কাজ করতেন মুন্না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রেস্তোরাঁয় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তার বাবা চট্টগ্রামে রিকশা চালান। মা শৈশবে মারা গেছেন। তাই পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন মুন্না।
দেখতে সুদর্শন মুন্না ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নারী-কিশোরীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারপর শারীরিক সম্পর্ক, টাকা আত্মসাত ও সর্বশেষে হত্যা করেন তাদের। রোববার (৩১ অক্টোবর) পিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর সোমবার (১ নভেম্বর) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মুন্না ও তার এক সহযোগী দীনু। গত ২৩ অক্টোবর রাত থেকে ২৫ অক্টোবর রাত ১২টার যেকোনো সময় পান্না আক্তারকে হত্যা করা হয়। পরে তার বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় মামলা দায়ের করেন পান্না আক্তারের মা নার্গিস আক্তার। এরপর মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করে পিবিআই। পান্না আক্তার দাউদকান্দির বানিয়াপাড়ার আমির হোসেনের মেয়ে।
পান্না আক্তারের মা নার্গিস আক্তার জানান, পান্নার চান্দিনা উপজেলার বেলাশহর গ্রামে বিয়ে হয়। তার সাত বছর ও আড়াই বছর বয়সী দুটি ছেলে রয়েছে। তার স্বামী প্রবাসে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমরা কেউই পান্নার প্রেমের বিষয়টি জানতাম না। তবে, আমার অনেক টাকা ঋণ ছিল। স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে প্রায় ১১ লাখ টাকা আমি পান্নাকে দেই। ভাবছিলাম, ওই টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করবো। কিন্তু প্রেমের ফাঁদে ফেলে মুন্না তার থেকে ওই টাকা আত্মসাত করেন এবং তাকে হত্যা করেন।
পিবিআই কুমিল্লার পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হিলাল উদ্দীন আহমদ জানান, গত দুইমাস আগে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মুন্নার সঙ্গে পান্নার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর দুজনের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মুন্না পান্নার কাছে টাকা দাবি করেন। কিন্তু চাহিদা মাফিক টাকা না পাওয়ায় তার প্রতি ক্ষিপ্ত হন মুন্না। একপর্যায়ে হত্যা করে সদর দক্ষিণের গোপীনাথপুরে সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজের পাশে তার মরদেহ ফেলে দেন মুন্না।
পুলিশ জানায়, গত ২ সেপ্টেম্বর বিকেলে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ধর্মপুর এলাকার মো. জনির স্ত্রী লাইলি বেগমকে (২৬) গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ থেকে দুইজন ছেলে অপহরণ করে নিয়ে গেছে মর্মে আদালতে মামলা দায়ের করেন লাইলির মা। গত ২৭ অক্টোবর মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
তদন্তে নেমে পিবিআই মুন্না ও তার সহযোগী দীন ইসলাম দীনুকে (১৯) ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। দীনু সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মো. মোস্তফার ছেলে।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর মহাসড়কের ঝাগরজুলি এলাকা থেকে লাইলিকে অপহরণ করেন তারা। এর একমাস আগে মুন্না তার বন্ধু সজীবের সহায়তায় লাইলির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার দিন লাইলি ২০ হাজার টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে উপজেলার ঝাগরজুলি এলাকায় মুন্নার সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় দীনুর সহায়তায় তাকে কৌশলে মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণের চেষ্টা করেন মুন্না। পথে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তার মরদেহ ফেনীর শর্শদী এলাকায় মহাসড়কের পাশের একটি ঝোপে ফেলে দেয় তারা। ওইদিন ফেনী সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ।
লাইলির মা নাজমা বেগম জানান, লাইলি এক ছেলে-এক মেয়ের জননী।
পিবিআই কুমিল্লার পুলিশ সুপার মিজানুর আরও জানান, দুটি হত্যাকাণ্ডের ধরণ একই হওয়ায় আমরা মুন্নাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দুটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি সিরিয়াল কিলার। আমরা সাম্প্রতিককালে কুমিল্লার সব নারী হত্যাকাণ্ডের ধরণ বিশ্লেষণ করছি। আমার ধারণা, এ দুটি ছাড়াও আরও একাধিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মুন্নার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
তিনি জানান, ওই দুটি হত্যাকাণ্ড ছাড়াও তিনি আরও দুই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর কথা স্বীকার করেছেন। তারাও হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হতে পারতো। এসব বিষয় থেকে অভিভাবক ও উঠতি বয়সী মেয়েদের শিক্ষা নিতে হবে। না হয় সব হারাতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০২১
আরআইএস