খুলনা: নামে নামে যমে টানে—প্রচলিত প্রবাদটি আবারও সত্য প্রমাণিত হয়েছে খুলনায়। অপরাধ না করেও নামের মিলের কারণে বার বার নারী নির্যাতন ও যৌতুক মামলায় জেল খাটছেন মোসলেম শেখ নামে ৭০ বছরের এক নিরপরাধ বৃদ্ধ।
নারী নির্যাতন মামলায় তাকে জেলে পুরে দিয়েছে পুলিশ। দীর্ঘ ৮ মাস ধরে জেল খাটছেন তিনি।
জানা গেছে, পিয়ারী বেগম (৪৫) নামে এক নারী তার স্বামী মোসলেম মিয়ার (৬০) নামে খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর অতিনি মামলাটি করেন। মামলা নম্বর ৭।
মামলায় মোসলেম মিয়াসহ ৫ জনকে আসামি করা হয়। আসামি মোসলেম মিয়া পুলিশের সাবেক এএসআই। বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। তার পিতার নাম সবেদ মিয়া। মামলায় মোসলেম মিয়ার দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি টাঙ্গাইলের বাশাইলের কাশিমপুর পূর্বপাড়া, পরেরটি খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গার সোনালীনগর বউবাজারের পূর্বপাশে।
এ মামলায় পুলিশ মোসলেম শেখ নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধকে আটক করেছে। যার পিতার নাম সবেদ শেখ। মোসলেম শেখের স্ত্রী বেঁচে নেই। অথচ তিনি স্ত্রীর দেওয়া মামলায় জেল খাটছেন। মোসলেম শেখের একমাত্র মেয়ে নাসরিনের পাইকগাছায় বিয়ে হয়ে গেছে।
সোনাডাঙ্গা থানাধীন সত্তার বিশ্বাস সড়কের সোনালীনগর এলাকার ১৯৭১ সালের আগে থেকে মোসলেম শেখ বসবাস শুরু করেন। তিনি পেশায় নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। গ্রেফতার হওয়ার পর নিরক্ষর মোসলেম শেখের কোনো আত্মীয়ও জানেন না, তিনি জেল খাটছেন। পিয়ারী বেগমের আরও একটি মামলায় তিনি আগেও জেল খেটেছেন।
মামলার বাদী পিয়ারী বেগম বলেন, ৪-৫ দিন আগে থানা থেকে নোটিশ আসে বুধবার সাক্ষী নিয়ে আদালতে যেতে। তারা বলেন, আমার স্বামী ৮ মাসের বেশি সময় জেল খাটছেন। আমি সাক্ষী দিতে গিয়ে দেখি পুলিশ যাকে আটক করেছে তিনি আমার স্বামী নন। একজন বাপ সমতুল্য লোককে আটক করে আমার স্বামী বানালে তো হবে না! আমি তখন পেশকারকে বার বার বলি ইনি আমার স্বামী নন। ইনাকে কেন আপনারা আটক করেছেন। আমার জানামতে, আমার স্বামী মোসলেম মিয়া গাজীপুরের শ্রীপুরে থাকেন। পলিশ যদি যাচাই-বাছাই করে নিতো তাহলে এই নিরপরাধ মানুষটিকে এতদিন জেল খাটতে হতো না। আমি চাই বৃদ্ধ মানুষটি মুক্তি পাক।
পিয়ারী অভিযোগ করে আরও বলেন, আমার স্বামী অবসরের আগে র্যাবেও কর্মরত ছিলেন। অবসরের পর বিভিন্ন সময় যৌতুকের জন্য আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। আমাকে রেখে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। ২৫-২৬ বছর সংসার করেছি। সোনালীনগর বউবাজারের পূর্বপাশে ৪ কাঠা জায়গা কিনেছিলাম। দুই কাঠা আমার নামে আর দুই কাঠা ছিল স্বামীর নামে। স্বামীর নামের জায়গা তিনি বিক্রি করে চলে গেছেন।
সাতক্ষীরা থেকে মোসলেম শেখকে গ্রেফতার করেছিলেন সোনাডাঙ্গা মডেল থানার তৎকালীন এসআই মো. সোবহান মোল্লা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পিয়ারী বেগমের নারী নির্যাতন মামলাসহ ৪টি মামলার ওয়ারেন্ট ছিল মোসলেমের বিরুদ্ধে। যে কারণে তিনি সাতক্ষীরায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাকে গত ৮ মার্চ গ্রেফতার করে ৯ মার্চ আদালতে পাঠানো হয়।
এই মোসলেম তো নাইটগার্ড, আর আসামি মোসলেম পুলিশের সাবেক এএসআই—জবাবে বলেন সোবহান মোল্লা বলেন, আমি তো নাইটগার্ডকেই ধরেছি। বিষয়টি কেমন হলো বুঝতে পারছি না!
খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, পিয়ারী বেগমের স্বামী পুলিশের এএসআই সোমলেম মিয়া তাকে রেখে আর একটি বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। পিয়ারী বেগমের ঘরে ওই পুলিশ সদস্যের তিনটি ছেলে রয়েছে। যাদের কোনো খোঁজ-খবর নেন না তিনি। তাই বাধ্য হয়ে পিয়ারী বেগম স্বামীর নামে যৌতুক, নারী নির্যাতন এবং দেনমোহর ও খোরপোষ মামলা করেন। পিয়ারী বেগমের স্বামীর নাম ও গ্রেফতার হওয়া নাইটগার্ডের নাম একই। বাবার নামও একই এবং বর্তমান ঠিকানাও একই সড়ক। যার কারণে পুলিশ মোসলেম মিয়ার স্থানে মোসলেম শেখকে আটক করেছে। মোসলেম শেখ পিয়ারী বেগমের অন্য মামলায় এর আগেও জেল খেটেছেন। সেই মামলায় আইনি সহযোগিতা দিয়ে তাকে নিষ্পত্তি করিয়েছি।
পারিবারিক জারি মামলায় মোসলেম শেখ ৮ মাস আগে গ্রেফতার হন। ৩ মাস আগে তাকে পিয়ারী বেগমের নারী নির্যাতন মামলায় শোন এরেস্ট দেখানো হয়। ১০ নভেম্বর পিয়ারী বেগমসহ ৩ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্য শুনে বিজ্ঞ আদালত বুঝতে পারেন ভুল গ্রেফতারের স্বীকার হয়েছেন মোসলেম শেখ। যে কারণে ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিজ্ঞ আদালত মোসলেম শেখকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। মূল আসামি পুলিশের সাবেক এএসআই মোসলেম মিয়ার নামে টাঙ্গাইলের স্থায়ী ঠিকানায় পুনরায় ওরেন্ট ইস্যু করেন।
অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ বলেন, এ লোকের নাম, বাবার নাম ও বর্তমান ঠিকানা একই হওয়ায় বার বার তিনি পিয়ারী বেগমের মামলায় আটক হচ্ছেন। কোর্ট যখন ওয়ারেন্ট ইস্যু করে তখন বর্তমান ঠিকানায় ইস্যু করে। বর্তমান ঠিকানা এক হওয়ার কারণে বার বার মোসলেম শেখকে আটক করা হচ্ছে। মামলার ওরেন্টের ভেতর যদি আসামির স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা থাকলে ভবিষ্যতে আর কেউ ভুল গ্রেফতারের শিকার হবে না বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক (জেলা জজ) মাহমুদা খানম আজ বিষয়টি জানার পর মোসলেম শেখের বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলা না থাকলে তাকে নিষ্পত্তি দিতে আদেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আদালতের কাছে মৌখিকভাবে মূল আসামি মোসলেম মিয়াকে গ্রেফতারের জন্য তার স্থায়ী ঠিকানায় ওয়ারেন্ট ইস্যুর আবেদন জানিয়েছি।
২০২০ সালের ১ জুলাই ‘আসামি না হয়েও জেল খাটছেন খুলনার সালাম ঢালী’ শিরোনামে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ৫ জুলাই মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র একটি রিট রায়ের করে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির সালাম ঢালীর দ্রুত মুক্তি চেয়ে পৃথক একটি রিট করেন।
গত ৬ জুলাই বিকেলে বাগেরহাটের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তন্ময় গাইন আসামির নাম, বাবার নামের এবং ঠিকানার একাংশের মিল থাকায় বিনা অপরাধে জেলে থাকা সালাম ঢালীকে মুক্তির আদেশ দেন। ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাগেরহাট জেলা কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২১
এমআরএম/এমজেএফ