ঢাকা: গত এক বছর ধরে রাজধানীর শ্যামলীতে 'আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল' চালু করেন গোলাম সরোয়ার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও এই হাসপাতালে ছিলেন মাত্র একজন এমবিবিএস চিকিৎসক।
এছাড়া হাসপাতালে ৩০টি বেড থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ১৫টি বেড। ৬টি নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ) থাকলেও অনুমতি ছিল মাত্র দুটির। আর আইসিইউগুলো হাসপাতালের দুটি ভেন্টিলেটরের মধ্যেই পরিচালনা করা হতো। ৯টি নবজাতক নিবিড় যত্ন ইউনিট' (এনআইসিইউ) থাকলেও ইনকিউবেটর ছিল মাত্র ১টিতে। অনভিজ্ঞ সাধারণ নার্স-চিকিৎসকরা এসব আইসিইউ ও এনআইসিইউ পরিচালনার করতেন। রোগীরা বিল না দিতে পারলেই মালিক গোলাম সরোয়ার রোগীদের বের করে দিতেন।
সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়োজিত দালালরা রোগীদের ফুসলিয়ে শ্যামলীর আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে ভর্তি করতো। নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দিয়ে মূলত আইসিইউ কেন্দ্রিক ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন মালিক গোলাম সরোয়ার। মুলত দালালি থেকেই তিনি শুরু করেন হাসপাতাল ব্যবসা।
আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে ভর্তি থাকা জমজ দুই শিশু ও তাদের মা আয়েশা আক্তার হাসপাতালের সম্পূর্ণ বিল না দেওয়ার কারণে শারীরিক নির্যাতন করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেন মালিক গোলাম সরোয়ার। এতে ভুক্তভোগী ও মায়ের ৬ মাসের দুই শিশুর মধ্যে আহমেদ মারা যায়। আর আব্দুল্লাহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে (ঢামেক) হাসতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
অমানবিক এই ঘটনায় জমজ দুই শিশুর মা আয়েশা আক্তার বাদী হয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক ও পরিচালককে আসামি করে একটি মামলা (নম্বর ৪২) দায়ের করেন। ওই মামলার প্রেক্ষিতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-২ ও র্যাব- ৩ যৌথ অভিযান চালিয়ে শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আমার বাংলাদেশ হাসাপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ারকে (৫৭) গ্রেফতার করে। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তিনি।
র্যাব জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গোলাম সরোয়ার ২০০০ সাল থেকে নিজেই দালালি পেশায় জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফুসলিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঠাতেন। এ কাজ করে গত ২০-২২ বছরে নিজেও রাজারবাগ, বাসাবো, মুগদা, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ৬টি হাসপাতালে পরিচালনা করছেন। সেগুলো হলো- ঢাকা ট্রমা হাসপাতাল, বাংলাদেশ ট্রমা হাসপাতাল, মমতাজ মেমোরিয়াল ডাগনস্টিক, আরাব ডায়াগনস্টিক, মোহাম্মদিয়া মেডিক্যাল সার্ভিসেস ও আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। তবে নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগে ইতোপূর্বে তার ৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু শ্যামলীতে 'আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল' চালু ছিল।
র্যাব জানায়, রোগী ভর্তির জন্য সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি কমিশনভিত্তিক একাধিক দালাল নিয়োগ করে রেখেছেন। আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে মূলত মোটা অংকের বিল ধরিয়ে দিতেন, আর জোরপূর্বক সেই টাকা আদায় করতেন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর শ্যামলীতে বেসরকারি আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ না করায় চিকিৎসাধীন জমজ শিশুকে জোর করে বের করে দেওয়ায় তাদের একজেনের মৃত্যু ও অপর জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নির্মম ও অমানবিক এঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। র্যাব তাৎক্ষণিক ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।
শর্ত না মেনেও কী করে হাসপাতালটি স্থাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন পেল সে বিষয়ে কোনো তথ্য র্যাব পেয়েছে কিনা- জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিগত সময়ে যখনই অনিয়ম-প্রতারণা ও রোগী জিম্মির বিষয়টি সামনে এসেছে তখনই তিনি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করেছেন। এরপর নতুন নামে ফের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি যখন অনুমোদন পান তখন হয়তো সে ধরনের শর্তপূরণের বিষয় পরিদর্শনে দেখিয়েছেন। তবে স্থাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা অভিযানের সময় ছিলেন, তারাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন। আমরা বিশদ জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব।
এদিকে অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে নির্যাতন করে জোরপূর্বক বের করে দেওয়ায় জমজ এক শিশুর মৃত্যুর কারণে হত্যার অভিযোগ আনা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। যেহেতু এখানে পোস্টমর্টেমের বিষয় আছে। ভুক্তভোগী মাও অভিযোগ করেছেন মামলায় যে, তাকেসহ জমজ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্তে ও ময়নাতদন্তে তা উঠে আসলে অবশ্যই হত্যার বিষয়টিও অভিযোগপত্রে আসবে।
যা ঘটেছিল: জমজ দুই শিশুকে চিকিৎসা করাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন মা আয়েশা আক্তার। তার স্বামী সৌদী প্রবাসী। গত ২ জানুয়ারি দালালরা তাকে ফুসলিয়ে ভালো চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান শ্যামলীতে 'আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। দুইদিন চিকিৎসা সেবার মধ্যে বিভিন্ন টেস্টের নামে মোটা অংকের বিল ধরিয়ে দেয় আয়েশা আক্তারকে। দুইদিন মোট বিল ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রাথমিকভাবে আয়েশা আক্তার হাসপাতালে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে বাকি টাকা ধীরে ধীরে দিয়ে দেবেন বলে সন্তানের চিকিৎসা চালাতে বলেন। কিন্ত সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ না করায় চিকিৎসাধীন জমজ শিশুসহ তাকে জোর করে বের করে দেন হাসপাতালের মালিক গোলাম সরোযার। পরে জমজ এক শিশুর (আহমেদ) নির্মম মৃত্যু ও অপর জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালের এইচডিইউতে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে শিশুটি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, ৭ জানুয়ারি, ২০২২
এসজেএ/এমএমজেড