ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘এশিয়া বুক অব রেকর্ড’র স্বীকৃতি পেল টিম খোরশেদ 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২২
‘এশিয়া বুক অব রেকর্ড’র স্বীকৃতি পেল টিম খোরশেদ 

নারায়ণগঞ্জ: দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এবার বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে টিম খোরশেদ। এর আগেও বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যরা টিম খোরশেদকে স্বীকৃতি দিয়ে ও তাদের কাজের প্রশংসা করেছেন বিশ্ব দরবারে।

শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) বিষয়টি জানিয়ে টিম খোরশেদের প্রধান সমন্বয়ক আলোচিত কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, আমরা মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শোকরিয়া জানাই। আমরা স্বীকৃতির জন্য নয়, মানুষের জন্য কাজ অব্যাহত রাখতে চাই। আবারও করোনা বাড়ছে আর আমরা এবারও প্রস্তুত মানুষের জন্য সর্বোচ্চটুকু করতে।

করোনা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দাফন-সৎকার, অক্সিজেন, প্লাজমা, অ্যাম্বুলেন্স ও টেলি মেডিসিন সার্পোট এবং খাদ্য, কর্ম ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ায় ‘এশিয়া বুক অব রেকর্ড’র স্বীকৃতি লাভ করেছে ‘টিম খোরশেদ’।

বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) ভারতের হায়দ্রাবাদে অবস্থিত ‘এশিয়া বুক অব রেকর্ড’র প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো সনদপত্র, মেডেল ও স্যুভেনির আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে টিম খোরশেদের কাছে পৌঁছেছে।

টিম খোরশেদের টিম লিডার কাউন্সিলার মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ এ অর্জনকে সব টিম মেম্বারদের প্রতি উৎসর্গ করে বলেন, এ স্বীকৃতি আমাদের সব স্বেচ্ছাসেবকদের ত্যাগের ফসল ও আল্লাহর রহমত। আমরা আমাদের ওয়াদা মোতাবেক করোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিম খোরশেদ সক্রিয় থাকবে ইনশাআল্লাহ।

টিম খোরশেদের কার্যক্রম সম্পর্কে টিম লিডার খোরশেদ বলেন, করোনা নামক মরণঘাতী মহামারি দামামা বাজিয়ে সারা বিশ্বকে টালমাতাল করে ৮ র্মাচ ২০২০ থেকে বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হলো নারায়ণগঞ্জে। সারা শহরের পাশাপাশি দেশব্যাপী এক অজানা মৃত্যু ভয় শঙ্কিত করে তুললো সবাইকে।

মৃত্যু ভয়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবো। আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের ওপর ভরসা করে ৯ র্মাচ থেকে কাজ শুরু করি। প্রথমেই আমরা করোনা থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে সচেতন করার জন্য লিফলেট ছাপিয়ে পাড়া-মহল্লায়, মার্কেট, বাজার, মসজিদ, মন্দিরে বিলি করা শুরু করি। সঙ্গে দেওয়া শুরু করি সার্জিক্যাল মাস্ক।

এভাবেই আমাদের শুরু। সপ্তাহ খানেক পরে ১৮ মার্চ সরকারিভাবে ঘোষিত হয় করোনায় একজনের মৃত্যু সংবাদ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যু ভয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্কেট, ফার্মেসিগুলো শূন্য হয়ে গেল, কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না স্যানিটাইজারসহ সুরক্ষাসামগ্রী। এ অবস্থায় আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিদ্যানন্দ থেকে ফর্মুলা নিয়ে স্যানিটাইজার বানানো শুরু করি। ১৮ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত আমরা ৬০ হাজার বোতল স্যানিটাইজার ও কাপড় কাচার সাবান প্রক্রিয়াজাত করে ১০ হাজার বোতল লিক্যুইড সাবান তৈরি করে পাড়া-মহল্লা পেরিয়ে সাড়া জেলায় বিনামূল্যে বিতরণ শুরু করি। এ সময়ে আমাদের নিয়ে সাধারণ মানুষ ও মিডিয়ার আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমাদের একটি টিম ওয়ার্কের নামকরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় আজকের ‘টিম খোরশেদ’র।

মার্চ ২০২০ এর শেষ দিকে করোনায় যখন মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন আমরা দেখি করোনা আক্রান্ত মরদেহগুলো দাফন বা সৎকার করা নিয়ে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তান তার মৃত মাকে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছে। কবর খননের লোক পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি কবরস্থানে দাফন করতে গেলে এলাকাবাসী বাধা দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা টিম খোরশেদের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনকে চিঠি দিয়ে করোনায় মরদেহ দাফন ও সৎকারের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করি এবং ৪ এপ্রিল থেকে আমরা করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মৃতদের দাফন ও সৎকার শুরু করি, যা ছিল সারাদেশের মধ্যে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগ। এর আগে আমরা আমাদের সহযোগী সংগঠন টাইম টু গিভের সহায়তায় লন্ডন রয়েল হসপিটালের করোনা ইউনিটে কর্মরত ডা. তানভীরের কাছে অনলাইনে প্রশিক্ষণ নেই কীভাবে করোনা আক্রান্ত মরদেহ হ্যান্ডেল করতে হয়। এরপরে আমরা স্থানীয়ভাবে কিছু পিপিই বানিয়ে, বাজার থেকে গামবুট ও গ্লাভস কিনে কাজে নেমে পড়ি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করে।

একের পর এক দাফন/সৎকার করা শুরু হলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই আমাদের সাবধান করেন, কেউ কেউ সরাসরি বাধাও দেন। কিন্তু আমরা আমাদের টিমের স্লোগান ‘করোনা আক্রান্ত মরদেহের স্বজন আমরা’ সামনে রেখে সব বাধা ও সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে দাফন ও সৎকার চালু রাখি।

আমাদের দাফন ও সৎকারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পরলে আমরা যেমন বাহবা পেতে শুরু করি, তেমনি মানুষের মধ্যে যে অজানা মৃত্যু ভয় কাজ করছিল তা আমাদের কাজ দেখে ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। বিভিন্ন জেলা থেকে যুবকরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে, তারাও তাদের জেলায় দাফন-সৎকারের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। আমরা অনলাইনে তাদের মরদেহ গোসল ও দাফনের পদ্ধতি শেখাই, তাদের সুরক্ষাসামগ্রী দেই। সর্বোপরি আমরা কতজন দাফন করলাম তার সংখ্যার কৃতিত্ব নেওয়ার চেয়ে আমরা গর্বিত এ কারণে যে, আমরা মানুষের ভয় দূর করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা মানুষকে সাহসী করতে পেরেছি। এটাই আমাদের মূল সার্থকতা।

ইতোমধ্যে আমরা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ১০ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে টেলিমেডিসিন সেবা শুরু করি। জুন থেকে টিম খোরশেদের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হয়। আমাদের টিমে যুক্ত হয় ফ্রি অক্সিজেন, ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রি প্লাজমা ডোনেশন প্রক্রিয়া। অদ্যবদি আমরা ৬৩০ জন মানুষকে ফ্রি অক্সিজেন সাপোর্ট, ১০৬ জনকে ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সাপোর্ট ও ১১২ জনকে প্লাজমা ডোনেশন, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সারাদেশের প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম হয়েছি এবং ২৮৫ জনের দাফন ও সৎকার সম্পূর্ণ করার পাশাপাশি নয় হাজার পরিবারকে কয়েক দফা খাদ্য সহায়তা দিতে পেরেছি। যা অঙ্কের হিসেবে প্রায় ১৭০ টনের ওপরে। আমরা ‘লকডাউন’ চলাকালে দরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য পক্ষকালব্যাপী প্রতিদিন এক হাজার পরিবারকে বিনামূল্যে তিন কেজি করে সবজি ও পরিবার প্রতি ছয়টি করে ৪০ হাজার ডিম বিতরণ করেছি। আমরা করোনায় কাজ হারানো মানুষকে সেলাই মেশিন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা দেই ও মধ্যবিত্ত্বের জন্য ৩০ শতাংশ ছাড়ে পণ্য সরবরাহ করি। আমাদের সব সেবা বিনামূল্যে করেছি।

আমরা এসব কার্যক্রম চালাতে এড়িয়ে গিয়েছি জাতি, ধর্ম ও দলমতের বেড়াজালকে। আমাদের সামনে একটাই টার্গেট ছিল যে কোনো উপায়ে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে হবে। আমরা শুরুর দিকে রোজা রেখেই অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মুখাগ্নি পর্যন্ত করেছি। ভয়ে কোনো আত্মীয়-স্বজন আসেনি মরদেহের সঙ্গে। তাই বাধ্য হয়ে আমরাই মৃতের স্বজন হয়ে মুখাগ্নি করেছি। অনেক মরদেহ উদ্ধার করে এনেছি বাড়ির সিঁড়ি ও উঠান থেকে। এমন অনেক মরদেহ আমরা দাফন করেছি, যাদের জানাজায় পরিবারের কেউ অংশ নিতে আসেনি করোনা আক্রান্তের ভয়ে। এমন মরদেহের কবরগুলো আমরা চিহ্নিত করে রেখেছি। যাতে পরবর্তী সময়ে তার পরিবারের কেউ এলে আমরা তাদের স্বজনের কবর চিনিয়ে দিতে পারি।

বিশ্বজুড়ে করোনার মতো ভয়াবহ মহামারি শতাব্দীতে একবার আসে। আমাদের জীবনকালে আর এ ধরনের বিপর্যয় আসবে না। তাই আমরা মনে করেছি মানব জন্ম সার্থক করার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময়। আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভয় পেয়ে পালিয়ে থাকলে চলবে না। আমরাও তো কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হতে পারি। আমাদের মরদেহও তো বাড়িতে পড়ে থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধুমাত্র শবযাত্রীর অভাবে। তাই মনের তাগিদ থেকেই আমরা করোনা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছি।  

আমরা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় জীবন বাজি রাখিনি। আমরা কোনো মৃত ব্যক্তির বাড়ি বা হাসপাতালে পৌঁছালে তার স্বজনের চোখে যে নির্ভরতার ছায়া দেখি সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। মানুষ আমাদের প্রতি যে বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছে সেটাই আমাদের আত্মতৃপ্তি। শুরু থেকে আজ প্রায় দেড় বছর হতে চললো একদিনের জন্যও আমরা পিছপা হইনি। আমরা আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখবো করোনার শেষ দিন পর্যন্ত।

আমি টিম লিডার হিসেবে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার সব টিম মেম্বারদের প্রতি। গত দেড় বছরে আমি ও আমার স্ত্রীসহ ১০ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েও আবারও কাজে ফিরেছি আল্লাহর রহমতে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই টাইম টু গিভ ও দিগন্ত ইন্টারন্যাশনালের প্রতি তাদের সার্বিক দিকনির্দেশনার জন্য। কৃতজ্ঞতা জানাই মডেল গ্রুপের প্রতি, তারা আমাদের জন্য একটি সর্বাধুনিক অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন। আমরা কখনো নগদ টাকা অনুদান হিসেবে গ্রহণ করি না। তাই ইতোমধ্যে যারা আমাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার, খাদ্যসামগ্রী, সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছেন তাদের প্রতিও আমরা চির কৃতজ্ঞ।

আল্লাহর রহমত ও সবার সম্মিলিত সহায়তায় আমরা বাংলাদেশকে করোনামুক্ত করতে ভূমিকা রাখবো এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২২
এমআরপি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।