ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জন্মান্ধ মিজানুরের অন্ধত্ব জয়ের গল্প

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২২
জন্মান্ধ মিজানুরের অন্ধত্ব জয়ের গল্প দোকানে বসে গ্রাহকদের টাকা দিচ্ছেন জন্মান্ধ মিজানুর রহমান।

কুড়িগ্রাম: আত্মবিশ্বাস ও প্রখর স্মরণশক্তি আর অনুভূতিকে পুঁজি করে ফ্লেক্সিলোডসহ লাখ লাখ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন জন্মান্ধ মিজানুর রহমান (২৬)।  শুধু তাই নয়, প্রায় ৭ সহস্রাধিক মোবাইলের নম্বর মুখস্থ তার।

মিজানুর চোখে না দেখলেও নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে ফ্লেক্সিলোড ও টাকা লেনদেন করতে পারেন। কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে সংরক্ষণের মতো স্থানীয় মানুষের সব মোবাইল নম্বর তার মুখস্থ। কেউ ফ্লেক্সিলোড করতে চাইলে নম্বর না বলে ব্যক্তির নাম বললেই টাকা চলে যায় মোবাইলে। তাই জন্মান্ধ মিজানুরের কাছেই টাকা ফ্লেক্সিলোড করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সবাই।  

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নতুন কেউ একবার ফ্লেক্সিলোড করলেই সেই নম্বরটি মিজানুরের মেমোরিতে সংরক্ষণ হয়ে যায়। এভাবেই পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন তিনি।

সরেজমিনে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত টাপুর চর বাজারের বটতলা মোড়ে গেলেই ফ্লেক্সিলোডের দোকানে দেখা মেলে জন্মান্ধ মিজানুর রহমানের।  

নাম বললে বা শেষের তিনটি সংখ্যা বললেই মোবাইল ফোনের বাটনে অনবরত টিপে চলেছেন নম্বর। আর এভাবেই লাইনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে টাকা রিচার্জ করছেন গ্রাহকরা।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও দ্রুততার সঙ্গে ফ্লেক্সিলোড করলেও দীর্ঘদিনে একবারের জন্যও ভুল করেননি তিনি। মোবাইল নম্বর তার লিখে রাখার তো প্রয়োজনই হয় না, বরং সারাদিনের হিসাব মুখস্থ থাকায় রাতে তা মেলাতে পারেন সহজেই।

মিজানুর উপজেলার বন্দবেড় ইউনিয়নের টাঙ্গারিপাড়া গ্রামের মোনতাজ আলী ও মোমেনা খাতুনের ছেলে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট বোন মরিয়মের বিয়ে দিয়েছেন। দিনমজুর বাবার দরিদ্র পরিবারে ইচ্ছা থাকলেও লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি। তাই এই কষ্ট বুকে লালন করেই মেধা আর প্রখর স্মরণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা করে পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এনেছেন পরিবারে।

মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আল্লাহর অশেষ কৃপায় দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে আসায় মোবাইল সেটের ওপর হাত রেখে বলে দিতে পারি কোন বাটনে কোন সংখ্যা আছে। ফ্লেক্সিলোডের সময় মোবাইলে কোন বাটন টিপে কোন অপশনে যেতে হবে তা আমার মেমোরিতে সেট হয়ে গেছে। এখন যেকোনো ধরনের মোবাইল সেট ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠাতে কোনো ধরনের সমস্যাই হয় না। শুধুমাত্র ইনকামিংয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির হটলাইনে কথা বলে নিশ্চিত হতে হয় বা কারো সহযোগিতা নিতে হয়’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘আমার অন্ধ দুই চোখের চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা করলে পৃথিবীর আলো দেখার পাশাপাশি সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্মজীবন ফিরে পাবো’।

মিজানুর তার মেধা ও স্মরণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তার ব্যবসার পরিধি আরও বাড়াতে চান। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে তা হয়ে উঠছে না। এ বিষয়ে সহযোগিতা পেলে আরও উন্নতির শিখরে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে সচ্ছলতার সঙ্গে চলতে পারবেন এমনটাই প্রত্যাশা তার।

মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করতে আসা গ্রাহক শাহজাহান আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘দৃষ্টিশক্তি না থকলেও আল্লাহ তাকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। কখনো তাকে মোবাইল নম্বর বলতে হয়নি, কন্ঠ শুনেই আমার ফ্লেক্সিলোড করে দিয়েছেন’।

আরেক গ্রাহক আব্দুর রাজ্জাক বাংলানিউজকে বলেন, ‘এলাকাবাসীর মোবাইল নম্বর তার মুখস্থ। কেউ মোবাইল রিচার্জ করতে চাইলে নাম বা শেষ তিনটি নম্বর বললেই মুহূর্তের মধ্যে টাকা চলে যাচ্ছে গ্রাহকের ফোনে’।

পাশের ফলের দোকানদার সওদাগর মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো মনোবল ও স্মরণশক্তির জোরেই ফ্লেক্সিলোড করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। দীর্ঘসময়ে গ্রাহকদের সঙ্গে টাকা লেনদেনে কোন সমস্যাও চোখে পড়েনি’।

মিজানুরের বাবা মোনতাজ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘সে জন্ম থেকেই অন্ধ ছিল। চিকিৎসার জন্য তাকে উলিপুর, রংপুর ও দিনাজপুরের চক্ষু হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চোখের অপারেশন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দিনমজুরি করে সংসার চালানোই দায়, তাই অর্থ সংকটে অপারেশন করা সম্ভব হয়নি। এখন ছেলে ব্যবসা করে সংসার চালালেও চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য নেই’।  

টাপুর চর বাজারের দোকান ঘর মালিক চাঁন মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘সহায় সম্বলহীন মিজানুর তার দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও মনোবলের জোরে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কারো কাছে হাত না পেতে ব্যবসা শুরুর সময় বাজারে আমার একটা দোকানঘর ভাড়া ছাড়াই তাকে দিয়েছি। ঘরভাড়ার কোন টাকা তার কাছে নেওয়া হয় না এবং ভবিষ্যতেও নেওয়া হবে না।

স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন সেন্টার ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মো. আবু হানিফ মাস্টার বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেড় বছর আগে জন্মান্ধ মিজানুর চিকিৎসা করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। চিকিৎসক দেখানোসহ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষও করানো হয়। পরে করোনার সময়ে আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা এগিয়ে নিতে পরেননি’।

রৌমারী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদা আকতার স্মৃতি বাংলানিউজকে বলেন, ‘জন্মান্ধ মিজানুর শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধীই নয়, একজন মেধা সম্পন্ন মানুষ। তাকে সব সময় বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করছি। তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডও করে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর তার যে ইচ্ছা তার পূরণে ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী মিজানুরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারসহ বিত্তশালীদের দৃষ্টি আশা করেছেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২২
এফইএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।