ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বাজানের মুখটা একটু দেখতে চাই’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
‘বাজানের মুখটা একটু দেখতে চাই’

অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সময় ঠাণ্ডায় জমে মারা যাওয়া সাত বাংলাদেশির একজন জয় তালুকদার (২৩)। তার বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ী গ্রামে।

বাবা পলাশ তালুকদার।

জয়ের পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ নভেম্বর জয় ও তার চাচাতো ভাই প্রদীপ তালুকদার (২১), মিঠু তালুকদার (২২), তন্ময় তালুকদারসহ (১৯) ছয় তরুণ ইতালি যেতে মাদারীপুর ছাড়েন।

প্রথমে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছেন তারা। সেখানে প্রায় দেড় মাস অবস্থান করেন। ইতালি যেতে গত ২২ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে সাগরপথে তাদের যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর এক দিন পর ভূমধ্যসাগরে প্রচণ্ড ঝড়-বাতাসের পর টানা বৃষ্টি শুরু হয়। নৌকাটি ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছলে ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডের সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেন। এ সময় নৌকা থেকে সাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতদের মধ্যে জয় রয়েছেন।

শনিবার (২৯ জানুয়ারি) সকালে বড়াইলবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জয়ের বাড়িতে শোকের ছায়া। ছেলের মৃত্যুর সংবাদে আহাজারি করছেন মা লক্ষ্মী তালুকদার। একটিবার ছেলের মুখ দেখতে সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। সাগরপথে যাত্রা শুরুর আগে জয়ের সঙ্গে মায়ের কথা হয় মুঠোফোনে। ছেলের সঙ্গে বলা সবশেষ কথা স্মরণ করে হাহাকার করছেন তিনি। বলছেন, ‘আমার বাজানে মরে নাই। ও কইছে, ইতালি গিয়া ফোন দিব। ওরে একবার ফোন দিতে কও। আমি বাজানের মুখটা একটু দেখতে চাই। ’ লক্ষ্মী তালুকদারের কান্নায় চারপাশে নেমে আসে গভীর স্তব্ধতা।

জয়ের বাবা পলাশ তালুকদার কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জয় মেজো। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। যে কামকাজ করি, তা দিয়া সংসার চালানো খুবই কষ্টের। আমাগো এলাকার ছেলে জামাল। সে-ই ইতালিতে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ওরে বিশ্বাস কইরা ধারদেনা কইরা আর জমি বেইচা সাত লাখ টাকা দিছি। এতগুলা টাকা গেল, তবু যদি পোলাডা বাঁইচা থাকত, দুঃখ থাকত না। আমাগো সব শ্যাষ হইয়া গেল। এহন পোলার লাশটা যেন পাই, সেটাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরার আবদার। ’

জয়ের কাকা গোবিন্দ তালুকদার বলেন, ‘আমার ছেলে প্রদীপ, ভাতিজা জয়সহ আমাগো বাড়ির চার ছেলে এই পথে ইতালিতে যায়। ওরা তিনজন কোনোমতে ইতালি পৌঁছলেও জয় পথে মারা গেল। আমার ছেলে প্রদীপ জয়ের মৃত্যুর সংবাদ জানাইছে আমাগো। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামাল খান বড়াইলবাড়ী গ্রামের সোনা মিয়া খানের ছেলে। ইতালিতে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতি পরিবারের কাছ থেকে তিনি সাত লাখ টাকা করে নেন। জয়ের মৃত্যুর খবর আসার পর তিনি গাঢাকা দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে জামাল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা রয়েছে। ওই মামলায় দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন তিনি। বছরখানেক আগে জামিনে মুক্ত হয়ে আবার শুরু করেন মানবপাচার।

মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘ঠাণ্ডার কারণে ভূমধ্যসাগরে মারা যাওয়া সাত বাংলাদেশির মধ্যে একজনের বাড়ি বড়াইলবাড়ী বলে জানতে পেরেছি। তার পরিবারকে থানায় দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে দালালের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হবে। ’

বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, সাতটি মরদেহ দেশে আনা বা দাফনের আগ পর্যন্ত ইতালির সিসিলি প্রদেশের এগ্রিজেন্তো এলাকার মর্গে রাখা যাবে। মরদেহগুলো দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। মরদেহ পরিদর্শনের জন্য আদালতের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় দূতাবাস গতকাল পর্যন্ত সেগুলো পরিদর্শন করতে পারেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।