ঢাকা: মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা আর বাংলা ফন্টের ব্যবহারকে আরও সাবলীল করতে বসুন্ধরা গুঁড়া মশলা ব্র্যান্ডের উদ্যোগে ভাষার মাসে তিনটি নতুন ফন্ট উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফন্টগুলো হলো—‘বসুন্ধরা ২১’, ‘বসুন্ধরা ৫২’ এবং ‘বসুন্ধরা ৭১’।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে গালুমগিরি সংঘের অনিন্দ্যসুন্দর এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফন্ট তিনটি সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সভাপতি ও বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও কবি হেলাল হাফিজ ফন্ট তিনটির উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন ফন্ট তিনটির নির্মাতা শিল্পী ও গ্রাফিক আর্টিস্ট সেলিম হোসেন সাজু, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং বিভাগের সিওও (সেক্টর-এ) এম এম জসীম উদ্দিন। আয়োজন সঞ্চালনা করেন গালুমগিরি সংঘের প্রধান সমন্বয়ক কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন।
‘বসুন্ধরা ৭১’ ফন্ট উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন
আয়োজনের শুরুতেই ফন্ট তিনটির নির্মাতা সেলিম হোসেন সাজু সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ২১, ৫২ এবং ৭১ এর চেতনাকে ধারণ করে এই ফন্টগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এই ধরনের কাজে পৃষ্ঠপোষক অনেক কম। তবুও বসুন্ধরা গ্রুপ এগিয়ে এসেছে এবং আমরা পেরেছি। আমি আশা করছি, ‘বসুন্ধরা ২১’, ‘বসুন্ধরা ৫২’ এবং ‘বসুন্ধরা ৭১’ ফন্টগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহাসিক সময়গুলোকে ধরে রাখতে পারবো।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ প্রত্যেকটি ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে চায়। ১৯৫২ সালে পত্র-পত্রিকাতে যে অক্ষরগুলো ব্যবহার করা হতো, সেই আদলে তৈরি হয়েছে ‘বসুন্ধরা ৫২’ ফন্টটি। ১৯৭১ সালে যে ফন্টটি ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে সে ধাঁচটি উঠে এসেছে ‘বসুন্ধরা-৭১’ ফন্টে। সাথে আরও কিছু অভিনব বিষয় যুক্ত করেই তৈরি হয়েছে ফন্টগুলো।
ফন্ট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন
‘বসুন্ধরা ৭১’ ফন্ট উদ্বোধন করে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, আমরা মনে করি একাত্তর, বায়ান্ন ও একুশ—আমাদের ইতিহাসের একটি ধারাকে রক্ষা করার ভেতর দিয়ে বর্ণমালার এই ফন্টগুলো আমাদের প্রজন্মের সামনে পৌঁছে যাবে। এতে তারা আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারবে। আমরা সকলে এখন যদি এই চেতনার বর্ণমালাগুলো ব্যবহারে নিজেদের উদ্যোগকে কাজে লাগাই, তবে এটি আমাদের কাছে একটি বড় দৃষ্টান্ত হবে। আর এই দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়েই পূর্ণ বৈচিত্র্যে এগিয়ে যাবে বাংলা ফন্টের একটি দিক।
‘বসুন্ধরা ৫২’ ফন্টের উদ্বোধন করে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, এই কাজের মাধ্যমে একটি নতুন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হলো আমাদের বর্ণমালার ক্ষেত্রে। ডিজিটাল মাধ্যমে এই ফন্টের মাধ্যমে আমরা বর্তমানকে ধারণ করবো এবং বর্তমানই আমাদের বর্ণিল সুন্দরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
‘বসুন্ধরা ২১’ ফন্ট উদ্বোধন করে প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ বলেন, এমন একটি ব্যতিক্রমী নান্দনিক শিল্পকর্মের কথা শিল্পীর মনে ও মগজে উদ্ভাসিত হয়েছিল এবং এটি সৃষ্টিতে তাড়িত করেছে, এজন্য শিল্পী এবং পৃষ্ঠপোষককে অভিনন্দন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেছে, অথচ শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে মহাকালের কাছে চিরস্থায়ী তেমন কোনো শিল্পকর্ম কিন্তু এখনো আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। তবুও আশা করি আজকের এই আয়োজন নতুন উদ্যোমে আমাদের পৃথক যাত্রার সূচনা করবে।
‘বসুন্ধরা ২১’ ফন্ট উদ্বোধন করেন প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ
কবি হেলাল হাফিজ ‘বসুন্ধরা ২১’, ‘বসুন্ধরা ৫২’ এবং ‘বসুন্ধরা ৭১’ ফন্ট তিনটিতে লিখে নিয়ে আসা তার তিনটি অনুকাব্য পাঠ করে শোনান দর্শক-শ্রোতাদের।
অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং বিভাগের সিওও (সেক্টর-এ) এম এম জসীম উদ্দিন বলেন, দেড় বছর ধরে এই ফন্টগুলোর কাজ হয়েছে। এর রৈখিক পরিবর্তন, আঙ্গিক পরিবর্ধন এবং তিনটি বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এখানে আমাদের যতটা বাণিজ্যিক চিন্তা এসেছে, তার থেকে বেশি চিন্তা এসেছে যে, বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ রাখতে হলে ডিজিটালি বাংলাভাষার ফন্টের কোনো বিকল্প নেই। কেননা যতদিন কম্পিউটার থাকবে, ততদিন এই ফন্ট থাকবে, এই ভাষা থাকবে। আমাদের দৈনন্দিন কাজ এবং হাজার হাজার বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পারি হাতেগোনা মাত্র দুই-তিনটি ফন্ট। তার বাইরে ব্যবহারকারীরা আর কোনো ফন্টের অপশন পাচ্ছেন না। যারা সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন একটা ফন্টের ভাষা আছে, ফন্ট কথা বলে। লিপির একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সেই ভাষাকে যদি আমরা ব্যক্ত করতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই অনেক রকম ফন্টের আয়োজন করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের লিপি আমাদের ডিজিটালি থাকতে হবে। কেননা হরেক রকমের চেতনা সমৃদ্ধ লিপি আমাদের সামনে থাকা দরকার।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে আলোকপাত ও চেতনায় ধারণ করে আরও একটি ফন্ট ডেভলপ করার জন্য নতুন তিনটি ফন্টের নির্মাতাকে আহ্বান জানান এম এম জসীম উদ্দিন। প্রয়োজনে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস দেন তিনি।
আয়োজনের শেষ পর্যায়ে প্রকাশ করা হয় উদ্বোধনী স্মারক গ্রন্থ। এতে অংশ নেন মঞ্চে উপস্থিত অতিথিসহ দেশবরেণ্য সাহিত্যিকরা। এই স্মারক গ্রন্থে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহানের লেখাসহ ফন্ট নিয়ে বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
‘বসুন্ধরা ২১’, ‘বসুন্ধরা ৫২’ এবং ‘বসুন্ধরা ৭১’ ফন্ট তিনটি তৈরি করতে অনুপ্রেরণা হিসেবে নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং আপামর বাংলার রূপ-বৈচিত্র্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
এইচএমএস/এমজেএফ