ঢাকা, সোমবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

‘পরিবারে ষাটোর্ধ্ব নারীরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২২
‘পরিবারে ষাটোর্ধ্ব নারীরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত’ বেগম রোকেয়া পদক গ্রহণ করছেন অর্চনা বিশ্বাস

যশোর: পিছিয়ে পড়া ও সুবিধা বঞ্চিত নারী-শিশুদের অধিকার, ক্ষমতায়ন ও বিকাশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অর্চনা বিশ্বাস। নিবেদিত প্রাণ মানুষটি আজীবন স্রোতের বিপরীতে লড়েছেন।

অনেক বাধা উপেক্ষা করে সফলও হয়েছেন। বর্তমানে যশোরের জয়তী সোসাইটির পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সমাজের অবহেলিত নারী ও শিশুদের উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। সর্বশেষ বেগম রোকেয়া পদক-২০২১ এ তাকে ভূষিত করা হয়েছে। তার সেই সংগ্রাম আর স্বপ্নজয়ের গল্প আজ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিশেষ আয়োজনে তুলে ধরা হলো।

অর্চনা বিশ্বাস ১৯৬৪ সালের ২ মে নড়াইল সদর উপজেলার নন্দীচর গ্রামে নিন্মবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পুলিন বিশ্বাস ও উর্মিলা বিশ্বাস দম্পতির সাত সন্তানের প্রথম মেয়ে তিনি।  

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। শৈশব থেকেই দেখেছি নারীদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন। পরিবারেও ছিল নারীর প্রতি বৈষম্যের ঘটনা। পরে বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। রাজনীতির কারণে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাই। খুব কাছ থেকেই দেখেছি সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট। এসব ঘটনা আমার মনে দাগ কাটে। মনের ভেতরের তাগিদ থেকেই অবহেলিত মানুষের প্রতি টান অনুভব করি। সেই থেকেই নারী ও শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে সম্পৃক্ত হয়েছি। আজও মানুষের সেবাই নিয়োজিত আছি। এভাবে নারীদের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজে এখনও সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ষাটোর্ধ্ব নারীরা। পরিবারের লোকজন এদের বোঝা মনে করে। কারণ এ বয়সের নারীরা কর্মক্ষম থাকে না। তাদের হাতে সম্পদও থাকে না। ফলে পরিবারে তাদের মূল্য থাকে না। সন্তান ও পুত্রবধূরাও তাদের উপেক্ষা করে। পরিবারের কেউ তাদের কথা শোনেও না। দরিদ্র পরিবারের বয়স্ক নারীদের অবস্থা করুণ। এদের নিয়ে তেমন কোনো সংগঠন কাজ করে না। জয়তী সোসাইটির উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক নারীদের খাদ্য, চিকিৎসা ও বস্ত্র সামগ্রী সহায়তা সেবা দিচ্ছি। সাবলম্বী পরিবারের অনেক বয়স্ক নারী পরিবারে বঞ্চিত। আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে তারা বাইরে বলতে পারে না। পুরুষের তুলনায় বয়স্ক নারীরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম নয়, নিরাপদ আনন্দ আশ্রম করতে চাই। স্বপ্নের এ কেন্দ্রে মায়েদের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। মায়েদের সঙ্গে পরিবারের দূরত্ব লাঘব হবে। পরিবার বিচ্ছিন্ন মায়েরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে।

সংগ্রামের কথা তুলে ধরে অর্চনা বিশ্বাস বলেন, নিন্মবিত্ত কৃষক পরিবারের জন্ম নিয়েছি। ছোটবেলা থেকেই তার ছোট কাকা প্রফেসর হরিপদ বিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় গ্রামীণ দরিদ্র অবহেলিত নারীদের শ্রেণি বৈষম্য, নির্যাতন ও অসমতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধে সমাধানের পথ খুঁজতে বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হই। এরপর স্কুল জীবনেই বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। স্কুলে গ্রামে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মেয়েদের সংঘবদ্ধ করে প্রতিবাদ করি। এভাবে সমাজের নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। এক সময় সরকারের রোষানলে পড়ি। আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। তারপর আত্মগোপনে গিয়েও কাজ চালিয়ে যাই। অধিকার সংগ্রামকালে পরিচয় হয় সহযোদ্ধা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে। ভালোবেসে ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করায় সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হই। সামাজিক বাধা পেরিয়ে যশোর শহরে এসে বসবাস শুরু করি। শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পাইনি। রাজনৈতিক কারণে স্বামী জেলে থাকায় সংসারে নেমে আসে চরম সংকট। গ্রামের একটি মেয়ে, লেখাপড়া শেখা হয়নি, ভালো চাকরি করারও উপায় ছিল না। যশোর শহরের বস্তিতে একটি স্যাঁতসেঁতে ছোট্ট ঘরে ছেলেকে নিয়ে শুরু করি জীবন সংগ্রাম। তখন পরিচয় হয় জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের নিবাহী পরিচালক আজাদুল কবির আরজুর সঙ্গে। তিনি বস্তিতে তিনশ টাকা বেতনে শিক্ষা সেবিকার কাজ করার প্রস্তাব দেন। বস্তিতে কাজ করার সময় দেখতে পাই সমাজের মানুষের আসল দুর্দশার চিত্র। বস্তির মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিয়োজিত হই। এরপর ভর্তি হই স্কুলে। ১৯৮৩ সালে যশোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। ১৯৮৫ সালে মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৮৭ সালে যশোর সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ও ১৯৯০ সালে খুলনার সরকারি বিএল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হই।

তিনি বলেন, বস্তির শিশুদের শিকার আলোয় আলোকিত করার জন্য ১২টি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছি। এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার শিশুকে শিক্ষায় আলোকিত করেছি। এদের মধ্যে চার হাজার শিশু উচ্চ শিক্ষা লাভ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। ১৯৮৭ সালে শহরের নাজিরশংকরপুরে প্রতিষ্ঠিত শিশু স্বর্গ প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে চার শতাধিক শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। চাকরির সুবাদে প্রায় পাঁচ হাজার বয়স্ক নারীকে শিক্ষার আলোয় আলোচিত করেছি। যশোর শহরের বস্তির নারীদের নিয়ে ৫৪টি সংগঠন গড়ে তুলেছি। এ সংগঠনের ২৫ হাজার নারী সদস্যকে যৌতুক, তালাক, ইভটিজিং, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন সম্পর্কিত আইন সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করছি। ওয়ার্ডভিত্তিক কিশোর-কিশোরীদের সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তুলতে সহায়তা করছি। নারীদের খেলাধুলা, যশোর শহরে প্রথম মোটরসাইকেল চালানো, গাড়ি চালাতে উৎসাহ দিয়েছি। প্রথমে নিজে চালিয়েছি। পরে ১২ জনকে মোটরসাইকেল চালাতে সহায়তা করি। নারী সুরক্ষায় নারী ও শিশুদের ক্রীড়া, ব্যায়াম, যশোর শহরে তথা বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ম্যারাথন দৌঁড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। এতে অংশ নেন ৫৫২ জন। পাঁচজনকে ফুটবল খেলায় উদ্ধুদ্ধ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাঠিয়েছি।  

বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বয়স্কদের জন্য নিরাপদ আনন্দ আশ্রম স্লোগানকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের নারী দিবসে জয়তী সোসাইটির উদ্যোগে ‘ষাটোর্ধ্ব নারী সেবা কর্মসূচি’ চালু করেছি। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বয়স্ক নারীকে এ কর্মসূচির আওতায় সেবা দিচ্ছি। নিয়মিত খাদ্য, চিকিৎসা ও বস্ত্র সহায়তা চালু রাখা হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২২
ইউজি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।