ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

দুর্নীতির আখড়া কিশোরগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস

নজরুল ইসলাম খায়রুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৭ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২২
দুর্নীতির আখড়া কিশোরগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস

কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালাল সিন্ডিকেটের সিল ছাড়া নড়ে না পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের আবেদনপত্রের ফাইল। সিল থাকলেই আবেদন ফাইল দ্রুত গতিতে চলে।

আর এজন্য প্রতি আবেদন ফাইলে নেওয়া হয় এক হাজার ১০০ টাকা।

‘চ্যানেল ফাইল’ নামে এভাবেই প্রতিদিন শত শত পাসপোর্ট আবেদন থেকে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি এখন ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি জেলা শহরের বাইরে সদর উপজেলার লতিবাবাদ ইউনিয়নের কাটাবাড়িয়া এলাকায় অবস্থিত। পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন ১৫-২০টি কম্পিউটার দোকান গড়ে উঠেছে। এসব কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করে স্থানীয় দালাল ও কম্পিউটার মালিকদের নিয়ে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। আর এই দালাল সিন্ডিকেটদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন আঁতাত রয়েছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুকৌশলে আদায় করা হয় ঘুষ বাণিজ্যের টাকা। জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩-৪শ’ পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলি কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনের সময় দোকান মালিক ও দালালরা আবেদনকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা আদায় করেন।

কম্পিউটার মালিকরা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিযোগ করে বাংলানিউজকে জানান, ‘চ্যানেল ফাইল’ এর নামে এক হাজার ১০০ টাকা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হয়। পাসপোর্ট আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় আবেদনপত্রের সঙ্গে চালান ফরমের যেকোনো স্থানে কম্পিউটার দোকানের সংকেত চিহ্নযুক্ত সিল ব্যবহার করা হয়। আর এ সিলের কারণে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বুঝতে পারেন এ আবেদনপত্রগুলো কার মাধ্যমে আসছে। এ ধরনের আবেদনপত্রগুলো পাসপোর্ট অফিস ও দালালদের মধ্যে ‘চ্যানেল ফাইল’ বলে প্রচলন রয়েছে। একেক কম্পিউটার দোকানে একেক সংকেত চিহ্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ধরনের আবেদনপত্র খুব সহজেই পাসপোর্ট অফিসে গ্রহণ করা হয়।

পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন আবেদনকারী বাংলানিউজকে জানান, যেসব আবেদনপত্রের ফাইলে কোনো সিল থাকে না সেসব ফাইল বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফেরত দেওয়া হয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের সঙ্গে খারাপ আচরণসহ নানাভাবে হয়রানি করারও অভিযোগ করেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন বিকেল ৪টার পরে ‘চ্যানেল ফাইল’ এর নামে কোন দালালের কয়টি আবেদনপত্রের ফাইল জমা হয়েছে তার হিসাব-নিকাশ করে দালালদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী হিসাব রক্ষক আনিছুর রহমান। পরে ‘চ্যানেল ফাইল’ এর প্রতিদিনের টাকা পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক ও তার কর্মচারীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

‘চ্যানেল ফাইল’ নিয়ে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী হিসাবরক্ষক আনিছুর রহমান সঙ্গে কথা বলা হয়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘চ্যানেল ফাইল’ এর নাম করে টাকা নেওয়া হয় না। তবে তিনি পাসপোর্ট অফিসের বিষয়ে কথা বলতে সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

অন্যদিকে সব নিয়ম মেনে পাসপোর্ট আবেদন করে পাসপোর্ট প্রাপ্তির তারিখ অতিবাহিত হলেও পাসপোর্ট আবেদনকারীরা মাসের পর মাস ঘুরেও তাদের পাসপোর্ট পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের বিল্লাল হোসেন তার পাসপোর্ট প্রাপ্তির তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ভৈরব উপজেলার শম্ভুপুর এলাকার হজযাত্রী সাহারা খাতুন তার পাসপোর্ট তারিখ ১৯ অক্টোবর ২০২১, বাজিতপুর উপজেলার নোয়াকান্দি হিলচিয়া গ্রামের রাকিব তার পাসপোর্ট প্রাপ্তির তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০২১ থাকলেও এখন পর্যন্ত তারা পাসপোর্ট পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনই প্রায় সাড়ে ৬ হাজার পাসপোর্ট আবেদনকারীরা মাসের পর মাস ঘুরেও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না।

এদিকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য তথ্য চাইলে সংবাদ কর্মীদের পুলিশের ভয়সহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার হুমকি দেন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। এ হুমকির বিষয়টি জানিয়েছেন দৈনিক জনতা পত্রিকার কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি নাজিম উদ্দিন ও দৈনিক মুক্ত খবরের কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি রঞ্জন মোদক রনি। পাশাপাশি সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কথিত কয়েকজন সাংবাদিকদের মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ ও অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি যাতে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ না হয় তারও তদবির করাচ্ছেন তিনি।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস কিশোরগঞ্জে পুরোদমে ই-পাসপোর্ট সেবা চালু হয়েছে। আপনারা জানেন যে, ই-পাসপোর্ট একটি অনলাইন সিস্টেম নির্ভর ব্যবস্থা। এখানে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করার পর আমাদের অফিসে আসতে হয়।

পাসপোর্ট আবেদনপত্রে সিল ও অফিসে দালাল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের কোনো সিলের ব্যাপারে আমার জানা নাই। এ ধরনের কোনো সিল দেওয়া হয় না। এখানে সবার ফরমই জমা হয়। আর এ ধরনের কোনো অভিযোগ এলে আমার কাছে আসে না। এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমার কাছে এলে আমি সেটা দেখবো। আমার অফিস চত্বরে দালাল প্রবেশ করতে পারে না। আমার ২৪টি সিসি ক্যামেরা এবং আমার রুমসহ ক্যামেরা সেট করা আছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।