ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ধুলো উড়িয়ে অবৈধ ট্রলির দাপট, ভাতেও বালু

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২২
ধুলো উড়িয়ে অবৈধ ট্রলির দাপট, ভাতেও বালু

 লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে ভবানীগঞ্জের সুতাগোপ্তায় গ্রামীণ একটি সড়কে প্রতিদিন দেড় শতাধিক পাওয়ার টিলার (ট্রাক্টর/ট্রলি) চলাচল করে।  

দানব আকৃতির এ বাহনটি দিনরাত মিলিয়ে অন্তত ১২-১৪ বার ওই কাঁচা সড়কটি দিয়ে ইটভাটার মাটি নিয়ে যাতায়াত করে।

এতে সড়কটি বিনষ্ট হয়ে হাঁটু পরিমাণ বালু জমে গেছে। বিরতিহীনভাবে চলাচলকৃত ট্রলির দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছেন সড়কের পাশের বাড়িঘরের কয়েক হাজার বাসিন্দা।  

রাস্তার ধুলোবালু প্রতিনিয়ত তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ভাত খেতে গিয়েও থালায় বালুর দেখা পান তারা। আর বালুর আবরণ পড়ছে ঘর-বাড়ি এবং বাড়ির অঙ্গিনায় থাকা শাকসবজি এবং ক্ষেতের ফসলের গায়েও। আসবাবপত্রে বালুর আস্তরণ পড়ে গেছে। রান্নাকরা খাবারেও মিশে যাচ্ছে ধুলোবালু।  

এনিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা দেড় শতাধিক ট্রলির মালিকরা প্রভাবশালী। এছাড়া ট্রলিগুলো নিয়ন্ত্রণে একটি সিন্ডিকেটও তৈরি করে নিয়েছেন তারা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ওই এলাকার ইটভাটার মালিক। তাদের প্রকাশ্য মদদে চলছে অবৈধ এসব ট্রলি। জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।  

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, ট্রলি এবং বালুর অত্যাচারে এলাকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে প্রতিবাদ  করার সাহস নেই তাদের। গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ্যে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে।  

তারা জানান, সোমবার (১৪ মার্চ) সকালে স্থানীয় নারীরা সড়ক অবরোধ করে অন্তত ২০টি ট্রলি জব্দ করেন। পরে ট্রলির মালিক এবং চালকরা তাদের হেনস্তা করে সেগুলো ছাড়িয়ে নেন এবং স্থানীয়দের হুমকি দিয়ে যান। তবে দুপুরে সদর থানা পুলিশ গিয়ে অবৈধ ট্রলি চলাচল বন্ধ রাখার অনুরোধ করলেও মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) ভোর থেকে পুরোদমে শুরু হয়েছে ট্রলি চলাচল।  

স্থানীয় এক নারী বলেন, আমরা প্রতিবাদ করে এখন হুমকির মুখে আছি। তারা বড় একটি দল তৈরি করেছেন। আমরা পুরোপুরি অসহায়। প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।  

একজন ভুক্তভোগী যুবক ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কোনো বক্তব্য দেননি। তার ভয়, এসব নিয়ে কথা বললে ট্রলি মালিকরা তাকে যে কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে দেবে। তার মতো অনেকেই তাদের দুর্বিসহ জীবনের চিত্র বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেছেন। নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে তাদের নাম গোপন রাখা হয়েছে।  

তারা জানান, ভবানীগঞ্জের চরমনসা গ্রামের সুতার গোপ্তা থেকে পূর্ব দিকে দেড় কিলোমিটার 'আইজিপি গণকবর সড়ক'। কাঁচা সড়কটির দু’পাশে সহস্রাধিক লোকের বসবাস। সড়কের পূর্ব অংশটি তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে আশেপাশের প্রায় ২০টির বেশি ইটভাটার জন্য এ সড়কের দু'পাশে থাকা কৃষি জমি থেকে মাটি কাটা হয়। মাটি বহনের কাজে ব্যবহার করা হয় দেড় শতাধিক অবৈধ ট্রলি।  

স্থানীয়দের হিসেবে, প্রতিটি ট্রলি দিনে এবং রাতে মিলিয়ে ১০-১২ বার আসা যাওয়া করে। চলতি মৌসুমে প্রায় দুই মাস ধরে ট্রলিগুলে চলাচল করছে। মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাণ্ডব থাকবে এ দানব যন্ত্রের। ট্রলির চাকায় পিষ্ট হয়ে সড়কটি একেবারে বেহাল অবস্থা হয়ে গেছে।

জানা গেছে, গেল অর্থ বছরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে সড়কটি উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর ট্রলির চাকার নিচে পড়ে সে অর্থ বিফলে গেছে।  

বাসিন্দারা বলেন, আমাদের জীবন একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এ দানবগুলো। সারাদিন ধুলোবালুর মধ্যে থাকতে হয়। রাস্তায় স্বাভাবিকভাবে কয়েক মিনিটের জন্যও বের হওয়া যায় না। পরনে থাকা কাপড় ধুলোয় বিবর্ণ হয়ে যায়। ঠিকমতো মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে বা বাজারে যেতে পারি না। কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে এ ভাঙা এবং বালুময় সড়ক দিয়ে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে কষ্ট হয়। কারণ ট্রলি ছাড়া এ রাস্তা দিয়ে আর কিছু চলে না। বর্ষাকালে রাস্তায় বড় বড় গর্ত এবং হাঁটু পরিমাণ কাঁদা থাকে। তখন চলাচল আরও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।  

কয়েকজন নারী তাদের রান্না করা খাবার দেখিয়ে বলেন, আমরা ভাতের সঙ্গে বালু খাই। কয়েক সেকেন্ডের জন্যও যদি খাবার ডাকনা দিয়ে না রাখি, তাহলে বালু পড়ে খাবারে। ঘরের প্রত্যেকটি অংশে বালুর আস্তরণ। হাঁড়ি পাতিল এবং ভাতের থালায় পর্যন্ত বালু।  

বাড়ির এক বাসিন্দা তার ক্ষেতের শাকসবজি দেখিয়ে বলেন, এখান থেকে কোনো শাক বা সবজি নিয়ে যে রান্না করব- সে উপায় নেই। সব কিছুতে বালুর আস্তরণ।  

রাস্তায় দেখা হয় স্কুল ও মাদরাসাগামী কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা বলে, বালুর কারণে পরনের কাপড় চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িতে ভিজা কাপড়ও রোধে শুকাতে দিলে ধুলো পড়ে।  

কয়েকজন কৃষক তাদের সয়াবিন ক্ষেত দেখিয়ে বলেন, রাস্তার নোনা ধুলোবালু এসে পড়েছে কচি সয়াবিন গাছের চারায়। ফলে গাছ মরে যাচ্ছে। এলাকার গাছপালা, ক্ষেতের ফসল বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।  

স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম বলেন, মুসল্লিরা নামাজ পড়তেও আসতে পারেন না। নামাজের জন্য একটি পোশাক পরে এলে, আর সেটি মুহূর্তেই বালুতে নষ্ট হয়ে যায়৷ মসজিদের প্রতিটি জায়াগায় বালুর আবরণ পড়ে আছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবানীগঞ্জ এবং তেওয়াগীঞ্জ এলাকায় স্থাপিত ইটভাটার মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা। দু’টি ভাটার মালিক ভবানীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল হাসান রনি। এছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী বাদল, মোক্তার হোসেন বিপ্লব ও মামুনুর রশিদ এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি রুবেল হাওলাদার ভাটার মালিক। পাশের তেওয়ারীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান ওমর হুসাইন ভুলুও ইটভাটার মালিক ছিলেন।  

মূলত তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এ সিন্ডিকেট। দেড় শতাধিক ট্রলির শতাধিক মালিক, দুই শতাধিক চালক এবং মাটি ব্যবসায়ীরা মিলিয়ে এলাকায় বিশাল একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। আর এ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের আইজিপি গণকবর রাস্তার পাশের সব বাসিন্দাই নদী ভাঙন কবলিত এলাকা থেকে এসে বসতি গড়েছেন। ফলে পুরো সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় এলাকার বাসিন্দারা।  

আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ ট্রলির বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। ফসলি জমির মাটি রক্ষার্থেও গ্রহণ করা হয়নি কোনো উদ্যোগ। যার ফলে ভুক্তভোগীরা এক দিকে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, অন্যদিকে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ সিন্ডিকেট।  

ইটভাটার মালিক ও ভবানীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল হাসান রনি বাংলানিউজকে বলেন, কয়েক মাস আগে রাস্তাটি পরিষদের পক্ষ থেকে সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু আবার নষ্ট হয়ে গেছে।

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করার জন্য লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান হোসেনের মোবাইল ফোনে গত দু’দিন থেকে বেশ কয়েকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।  

তবে জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, রাস্তায় ট্রলি চলাচলের কোনো অনুমতি নেই। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। ট্রাক্টর বা ব্যবহার করার কথা কৃষি কাজে।  

বেশ কয়েকটি ট্রলিকে জরিমানা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ ট্রলি রাস্তায় চলাচল বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।