ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

স্বজনদের থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে মেঘনা

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১২ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০২২
স্বজনদের থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে মেঘনা বিরান বসতভিটায় রয়ে গেছে প্রাণচাঞ্চল্যের চিহ্ন

মেঘনা নদীর উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। নদী এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যেমন আশির্বাদ, তেমনি অভিশাপও।

নদী অনেক মানুষকে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দিয়েছে, আবার অনেককে সর্বশান্তও করে দিচ্ছে। নদী কেন্দ্রিক বাসিন্দাদের দুঃখ-দুর্দশা এবং জীবনচিত্র নিয়ে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের মধ্যে আজ থাকছে কীভাবে মানুষকে স্বজনদের কাছ থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে মেঘনা

লক্ষ্মীপুর: মেঘনা নদী শুধু উপকূলীয় বাসিন্দাদের বসতবাড়িই ভেঙে নিচ্ছে না, ভেঙে দিচ্ছে তীররর্তী বাসিন্দারের ঐক্যবদ্ধতাও। বছরের পর বছর একসঙ্গে বসবাস করা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীকে একে অপরের কাছ থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে তাদের বন্ধন।  

এ যেন ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ পড়ার মতো অবস্থা। ভাঙনের ক্ষতের মধ্যে দূরত্বের ক্ষতও তৈরি হচ্ছে তাদের অন্তরে। আর পরিবারের যে সব সদস্যরা বেঁচে নেই, তাদের সমাধিস্থলও নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে করালগ্রাসী মেঘনা।   

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলা সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চরজগবন্ধু গ্রামের সফিক উল্যার পাঁচ ছেলে একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বসবাস করে আসছিলেন। ৫০ বছরের পুরোনো বাড়িটি নদীর খুব কাছেই। তাই ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে বাড়ির বাসিন্দারা যে যার মতো অন্যত্র বসতি গড়েছেন। একেক জন একেক জায়গায় চলে যাওয়ায় একে অপরের কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।  

সফিক উল্যার ছোট ছেলে আবুল হোসেন এখন বাড়িতে আছেন।  বাড়িটা এখন খাঁ খাঁ করে।   বড় ছেলে ইসমাইল হোসেন ও তৃতীয় ছেলে আমির হোসেনের ছেলেমেয়েরা উপজেলার করইতোলা বাজার এলাকায় বাড়ি করেছেন। মেঝো ছেলে মোবারক হোসেন চলে গেছেন নোয়াখালীর চাটখিলে। আর নুর হোসেন বসতি গড়েছেন বর্তমান বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে।

আবুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কয়েকদিনের মধ্যে আমাকেও কোথাও না কোথাও যেতে হবে। আমাদের ভাইদের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হচ্ছে। মেঘনা আমাদের একসঙ্গে বসবাস করতে দিল না।  

তিনি বলেন, বাড়িতে যখন একসঙ্গে ছিলাম, একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতাম। আপদে-বিপদে এগিয়ে আসার সুযোগ হতো। কিন্তু এখন চাইলেও সম্ভব হবে না। একেক জন একেক জায়গায়। একই গ্রামে সমাজবদ্ধ হয়ে অনেকের সঙ্গে বসবাস করতাম। অনেক প্রতিবেশী ছিল। কিন্তু এখন সবাই ছিন্নভিন্ন।  

বাবা এবং এক ভাইয়ের কবর বাড়ির সামনেই। এছাড়া পরিবারের অন্তত আরও ১০ জন সদস্যের কবর রয়েছে পারিবারিক কবরস্থানে। কিন্তু নদী তাদের শেষ স্মৃতিও কেড়ে নিচ্ছে। বাবা-ভাইয়ের কবরটুকুও আর থাকল না, যোগ করেন তিনি।  

আবুল হোসেনের প্রতিবেশী দুলাল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা চার ভাই। সবাই একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বসবাস করতাম। এখন বাড়ি নদীগর্ভে। চার ভাই চার স্থানে। এখন কারো সঙ্গে কারো সহজে দেখা হয় না। বসতভিটা ছাড়ার তিনদিনের মাথায় বাবা মারা যান। পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা সম্ভব হয়নি। কারণ সেটিও ভাঙনের মুখে। নদী ভাঙন আমাদের একে অপরকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।  

কমলনগরের চর ফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া বাজারের পশ্চিম পাশে জয়নাল আবেদীন মিঝি বাড়ি। প্রায় ৬০-৬৫ বছর আগে জেলে জয়নাল মিয়া এ বাড়িতে তার চার ছেলেকে নিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন। তিনি আজ বেঁচে নেই। তবে তার চার ছেলের মধ্যে দুই ছেলে এখনো জীবিত। মৃত জয়নাল মিয়ার শতাধিক উত্তরসূরির বসবাস ছিল এ বাড়িতে। বসতঘরের সংখ্যা ছিল ১২টি। পরিবারের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলেমিশে থাকতেন এখানে।  

সম্প্রতি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ৬০-৬৫ বছরের একতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পুরো বাড়ি চলে গেছে মেঘনার তলদেশে।  

মৃত জয়নাল মিয়ার যে দুই ছেলে বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে একজন নুরুজ্জামান মিঝি। বয়স ৮৩। শেষ বয়সে তার আপেক্ষ, মরে গেলে বাবার কবরের পাশে তার দাফন হবে না। আর জানাজায় হয়তো একত্র হতে পারবেন না বাড়ির লোকজন।  

তিনি বলেন, আমাদের বংশের ১২টি পরিবার এখন ১২ স্থানে গিয়ে বসবাস করছে। তাই সবার কাছ থেকে বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। শেষ জীবনে অনেকের সঙ্গে আর দেখা নাও হতে পারে। বাবার কবরসহ বংশের প্রায় ১৫ জন সদস্যের সমাধিস্থল ছিল। নদী পূর্ব পুরুষদের সমাধিস্থলও নিয়ে গেছে।  অন্য গ্রামে চলে যাচ্ছে একটি পরিবার

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ নুরুজ্জামান। বললেন, বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এতো বছরের একতা এখন বুঝি শেষ হয়ে গেল।

নারী-পুরুষসহ বাড়ির কয়েকজন বাসিন্দা বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ সময় থেকে আমরা সুখে, দুঃখে একসঙ্গে থেকেছি। একে অন্যের বিপদে এগিয়ে গেছি। বাড়িতে বিয়ে-শাদী, ঈদ বা যে কোনো অনুষ্ঠানে সবাই একসঙ্গে আনন্দ করতাম। এখন ১২ পরিবার ১২ জায়গায় গিয়ে উঠেছে। ফোনে যোগাযোগ থাকলেও কারো সঙ্গে কারো হয়তো আর দেখা হবে না। একে অন্যের বিপদে বা সাহায্যার্থে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।  

তারা বলেন, একদিকে বসতবাড়ি ভাঙনের ক্ষত, অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া। এটাই উপকূলীয় বাসিন্দাদের ভাগ্যের পরিহাস।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।