ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টাকায় মেলে চিকিৎসা সনদ! 

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০২২
শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টাকায় মেলে চিকিৎসা সনদ!  অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর

সাতক্ষীরা: মুকুন্দপুর গ্রামের ২৭ বছরের মনোয়ারা খাতুন ১৬ মার্চ রাতে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৭ ও ১৮ মার্চ শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের পর আদালত হাসপাতাল থেকে বাদীর চিকিৎসা সনদ তলব করেন।

এসময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী আসামি পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঘটনা ১৫ মার্চের উল্লেখ করে ওই নারী ১৬ মার্চ ভর্তি হন- মর্মে আদালতে মিথ্যা ‘ইনজুরি রিপোর্ট’ দেন।  

ঘটনা ও ভর্তির তারিখের গরমিলের সুযোগে আসামিকে জামিন দেওয়ার পাশাপাশি আদালত মামলা খারিজ করার ঘোষণা দেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী মনোয়ারা নির্ভুল চিকিৎসা সনদ উপস্থাপনের জন্য আরও একবার আদালতের কাছে সময় প্রার্থনা করেন। এসময় ভর্তির দিনক্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন সংক্রান্ত প্রকৃত প্রতিবেদন দেওয়ার বিনিময়ে অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম ভুক্তভোগী নারীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নেন বলে অভিযোগ উঠেছে।  

একইভাবে প্রতিবেশীর হামলায় আহত পাইকামারী গ্রামের আক্তার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা খাতুন (৩৫) গত ২৯ জানুয়ারি শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে একদিন পর ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িতে ফেরেন। পরে মামলা হলে আদালত চিকিৎসা সনদ তলব করায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী ‘ভালো মানের’ চিকিৎসা সনদ দেওয়ার শর্তে ১৮ হাজার টাকা দাবি করেন। তবে দরিদ্র ভুক্তভোগীর পরিবার ১২ হাজার টাকার বেশি দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করায় তার চিকিৎসা সনদে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়।

এছাড়া গত ২২ জানুয়ারি পীরগাজন আশিকুড়া গ্রামের ডিএম মনিরুজ্জামানের হাতে নির্যাতিত হয়ে তার স্ত্রী শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। পরে জামিন নেওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন মহলে তদবিরের পাশাপাশি স্ত্রীর চিকিৎসা সনদের বিষয়ে ধারণা নিতে তিনি শ্যামনগর হাসপাতালে যান। একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর আলম এক হাজার টাকা নিয়ে তাকে ভুক্তভোগীর ‘কেস সামারি’ লেখা রেজিস্ট্রার খাতার ছবি মোবাইল ফোনে ধারণের সুযোগ দেন।

পরে মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ‘কেস সামারি’ পর্যবেক্ষণ করে আইনজীবীরা জামিন সহজ করার জন্য বিবাদীকে যোগাযোগের মাধ্যমে মেডিক্যাল সনদ ‘নরমাল’ করার পরামর্শ দেন। এরপর মনিরুজ্জামান দ্বিতীয়বার জাহাঙ্গীরের কাছে যান। আসামি সরকারি চাকরিজীবী নিশ্চিত হয়ে শুরুতে নরমাল চিকিৎসা সনদ দেওয়ার বিনিময়ে জাহাঙ্গীর ৫০ হাজার টাকা দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকায় দফারফা হয়।

তবে শুধুমাত্র উল্লিখিত তিনটি ঘটনা নয়, বরং শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া রোগী ও তার প্রতিপক্ষের চাহিদামতো চিকিৎসা সনদ সরবরাহ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রেজিস্ট্রার খাতা রক্ষণাবেক্ষণসহ দাপ্তরিক বিষয়াদী দেখভালের পাশাপাশি মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকের ব্যস্ততার সুযোগে অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম এমন অপকর্ম করেন।

অভিযোগ রয়েছে, অফিস সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন একই স্টেশনে চাকরির সুযোগে জাহাঙ্গীর আলম তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থা বিবেচেনার পরিবর্তে টাকার অংকের ওপর নির্ভর করে মেডিক্যাল বোর্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা সনদ পাইয়ে দিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার এমন অপকর্মের কারণে অসংখ্য দরিদ্র অসহায় ভুক্তভোগী আদালতে যেয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি স্থানীয়দের।

ওসমান আলী নামের কৈখালী গ্রামের এক বৃদ্ধ জানান, গত ১৯ এপ্রিল প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি হলেও জাহাঙ্গীরের কারসাজিতে অপরাধীরা অল্প সময়ের মধ্যে জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরে তাকে হুমকি দিচ্ছে। তার মতো আরও অনেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের টাকার যোগান দিতে ব্যর্থ হয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও তার দাবি।

অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, থানা থেকে কোনো প্রতিবেদন চাইলে আমি কাগজপত্র প্রস্তুত করে মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে উপস্থাপনের পর তারা চিকিৎসা সনদ দেন।  

এখানে বোর্ডকে প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ নেই দাবি করে তিনি আরও বলেন, মনোয়ারা খাতুনকে নিয়ে একটি অভিযোগ হওয়ায় বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে। এরপর মানসিক অবস্থা ভালো না দাবি করে পরক্ষণে তিনি ব্যস্ত থাকার কথা জানিয়ে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন তিনি।  

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জিয়াউর রহমান জানান, এরই মধ্যে একটি অভিযোগ আমার হাতে এসেছে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।  

এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেকে সত্যিকারের সেবাদান প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিযোগের সত্যতা মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ২২০৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad