ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

বঙ্গবন্ধু হত্যা, পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয় বিচার

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২২
বঙ্গবন্ধু হত্যা, পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয় বিচার বঙ্গবন্ধু

ঢাকা: বাঙালি জাতির জন্য একটা দুঃস্বপ্নের রাত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এদিন রাতে।

সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী জুনিয়র অফিসার অংশ নেয় কিলিং মিশনে। এ হত্যাকাণ্ডের পর আইন করে খুনিদের বিচার থেকে দায়মুক্তি পর্যন্ত দেওয়া হয়।  

শুধু তাই নয় বিভিন্ন বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে তাদের করা হয় পুরস্কৃত। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করে। মাঝে বিচারকাজ স্থবির হয়ে যায়। পদে পদে বাধা উপেক্ষা করে ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতায় এসে এই বিচার শেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

ইন্ডেমিনিটি অধ্যাদেশ 
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তারই মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করতে একটি অধ্যাদেশ (রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নং-৫০) জারি করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩ এর অধীন প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাক এই অধ্যাদেশ জারি করেন। অধ্যাদেশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং পরদিন জারি করা সামরিক শাসন ও তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে অধ্যাদেশটি আইন হিসেবে পাশ করা হয়। যা ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয়।  

অধ্যাদেশ বাতিল ও মামলা 
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ আসন পেয়ে জাতীয় পার্টির সমর্থনে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেই সেই সরকার বিচারে দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) এএফএম মহিতুল ইসলাম। এই মামলার বিচারের পথে বাধা দূর করতে একই বছর ১২ নভেম্বর ইন্ডেমিনিটি অধ্যাদেশটি সংসদে বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এএসপি আবদুল কাহার আকন্দ ২০ জনকে অভিযুক্ত করে এই মামলায় চার্জশিট দাখিল করেন। তদন্তে খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ আরও কয়েকজনের নাম এলেও মারা যাওয়ায় বিচার কার্যক্রম থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়।  

বিচার ও রায়

প্রথম রায় চার্জশিট দাখিলের পর ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল। রায়ে তিনি মামলার ১৫ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

দ্বিতীয় রায় নিম্ন আদালতে রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে যায়। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারপতি এম রুহুল আমিন এবং এ বি এম খায়রুল হক বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অন্যদিকে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। নিয়ম অনুযায়ী এই মামলার নথি  হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে পাঠানো হয়। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন বাকি তিনজনকে। এই মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) আগেই গ্রেফতার হন। এরপর থাইল্যান্ড থেকে ১৯৯৮ সালে আরেক আসামি বজলুল হুদাকে ফিরিয়ে আনা হয়।

আপিল শুনানিতে দীর্ঘ অপেক্ষা

হাইকোর্টের রায়ের পর কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। তবে চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে নানা অজুহাতে সেই আপিল নিষ্পত্তি বিলম্বিত করে। হাইকোর্টের রায়ের দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে আসা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে আরেক খুনি লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনে। দেশে আসার পর এ কে এম মহিউদ্দিনও আপিল করেন। সেই সময়ে ৫ জনের আপিলই শুনানির জন্য গ্রহণ করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুাননিতে ফের গতি পায়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মামলাটি শুনানির জন্য ২০০৯ সালের ৭ আগস্ট বিচারপতি মো. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি আপিল বেঞ্চ গঠন করে দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর এই বেঞ্চ হাইকোর্টের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৫ আসামির আপিল খারিজ করে রায় দেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে যায়।

দণ্ড কার্যকর রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি) ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ৭ আসামির মধ্যে ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদকে ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। এরপর একই বছর ১২ এপ্রিল দিবাগত রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়। এছাড়া খুনি আবদুল আজিজ পাশা ২০০১ সালের জুন মাসে জিম্বাবুয়েতে পলাতক অবস্থায় মারা যান।

এখনো পলাতক ৫ বঙ্গবন্ধুর খুনি 
৫ আসামি খন্দকার আবদুর রশিদ, এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান এখনো পলাতক। পালিয়ে থাকা খুনিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন এম রাশেদ চৌধুরী। আর কানাডায় অবস্থান করছেন খুনি নূর চৌধুরী। বাকি তিন খুনির কোনো হদিস নেই। এম রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে সরকার।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২২
কেআই/এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।