ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির ‘মা’, আজও মেলেনি স্বীকৃতি!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির ‘মা’, আজও মেলেনি স্বীকৃতি! রান্না করছেন মাসুরা। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মায়ের রেকর্ড রয়েছে আমেরিকার স্টেসি হেরাল্ডের। মাত্র ২৮ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে ২০০৬ সালে প্রথম ‘মা’ হন এই খর্বাকায় নারী।

কয়েক বছরের ব্যবধানে তিন সন্তান জন্ম দেন। এরপর ২০১৮ সালে স্বাভাবিকভাবেই মারা যান রেকর্ডধারী স্টেসি হেরাল্ড। আর মাত্র ৩৮ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে ২০১৩ সালে মা হয়েছেন রাজশাহীর মাসুরা বেগম। তাই উচ্চতা হিসাবে মাসুরা বিশ্বের দ্বিতীয় এবং এশিয়ার প্রথম খর্বাকৃতির মা। আর তিনি জীবিত এবং সন্তান ও স্বামী নিয়ে দিব্যি সংসার করে চলেছেন।

শরীরে ওজন ও উচ্চতা কম, তাতে কী? এই কম উচ্চতা নিয়েই বাড়ি-ঘড় ঝাড়ু দেওয়া, মসলা বাটা, রান্নাবান্না করা, পানি আনাসহ নিজের ও স্বামী সন্তানের সব কাজ করেন একা হাতেই। তবে কেবল প্রচারণার অভাবে রাজশাহীর এই খর্বাকৃতি মায়ের নাম এখনও গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ওঠেনি!



এদিকে ভারতের গণমাধ্যমও তাদের দেশের একজন ক্ষুদ্রাকায় নারী মায়ের দাবি তুলেছে। যদিও তার উচ্চতা ৪১ ইঞ্চি। সেই দেশের গণমাধ্যমের মতে, এই উচ্চতা নিয়ে ভারতের কামাক্ষী রানি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মা। যিনি ২০১১ সালে সফলভাবে সন্তান প্রসব করেছেন। তবে রাজশাহীর মাসুরা বেগমের উচ্চতা ৩৮ ইঞ্চি। যা কামাক্ষীর চেয়েও তিন ইঞ্চি কম। অর্থাৎ রাজশাহীর মাসুরাই পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মা।

রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বজরপুর গ্রামের মাদরাসা মোড়ে বাড়ি মাসুরার। গাইবান্ধা থেকে এই গ্রামে কাজ করতে এসেছিলেন মনিরুল ইসলাম। সেখানেই দেখে মাসুরাকে দেখে পছন্দ করেন। এরপর ২০০৩ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন মাসুরাকে। তবে বয়স ও আকৃতির কারণে মাসুরাকে বিয়ে করতেও বেগ পেতে হয় তাকে। কারণ ওই সময় মাসুরার বয়স ছিল ১৪ বছর আর ওজন ১০ কেজি! 

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও বগুড়াসহ কয়েক জায়গায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়ে পড়াতে রাজি হন এক কাজী। বিয়ের প্রায় ১০ বছর পর ২০১৩ সালে মাসুরা ও মনিরুলের সংসার আলো করে আসে একটি কন্যাসন্তান। গর্ভকালীন সময়ে শতকষ্টেও প্রতিটি মুহূর্তে মাসুরার পাশে ছায়া হয়ে থেকেছেন স্বামী মনিরুল ইসলাম।

স্ত্রীকে কোলে করে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রাজশাহী হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। গর্ভধারণের আট মাস ১০ দিন পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। ওই সময় মাসুরার স্বাভাবিক ওজন সাড়ে ১১ কেজি হলেও গর্ভধারণের সময় তার ওজন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে ১৭ কেজি। মাসুরার সেই মেয়ের বয়স এখন ৯ বছর। নাম মরিয়ম খাতুন। সে এরই মধ্যে উচ্চতায় জন্মদাতা মাকে ছাড়িয়ে গেছে। তার উচ্চতা ৪২ ইঞ্চিতে পৌঁছেছে এখনই।



মাসুরার গর্ভকালীন চিকিৎসক রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের তৎকালীন প্রধান প্রফেসর ডা. হাসিনা আক্তার ও আবাসিক সার্জন নূরে আতিয়া লাভলী। তাদের মতেও রাজশাহীর পবার এই মাসুরাই এশিয়ার খর্বাকৃতির মা।

এত কম ছোট শারীরিক গঠনে গর্ভধারণ প্রশ্নে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. নূরে আতিয়া লাভলী বলেন, মাসুরার গর্ভধারণের বিষয়টি একেবারেই আশ্চর্যজনক! মাসুরা তাদের কাছে যাওয়ার পর তারা প্রথমে সবায়ই অবাক হয়ে গিয়িছিলেন। তাই তাদের পুরো ইউনিট মাসুরার দিকে বাড়তি দৃষ্টি রেখেছিল। তারা মাসুরাকে কোলে তুলে নিয়ে চিকিৎসা দিতেন। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তারা মাসুরার গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের জটিল চিকিৎসা নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন বলেও জানান।

বর্তমানে মাসুরার বয়স ৩৩ বছর। তার ওজন ১২ কেজি। তবে প্রায় দেড় যুগ ধরে খবর্কায় স্ত্রী মাসুরার সঙ্গে ঘর বেঁধে সুখেই সংসার করছেন মনিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, মানুষের শরীরিক যোগ্যতা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এটি মানুষের একমাত্র মানদণ্ড নয়। ভালোবাসার জন্য প্রয়োজন একটি সুন্দর মন। তাই সবাই যখন মাসুরার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।  তখন তিনি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিকে তার পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। তবে তিনি পরে সবাইকে এই বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে আজও পাশাপাশি থেকে সংসার করে যাচ্ছেন। চলার পথে ভাগ করে নিচ্ছেন জীবনের সব সুখ-দুঃখ। অভাব-অনটন রয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাদের সংসারে ভালোবাসার কোনোকমতি নেই বলে জানান মনিরুল ইসলাম।



মনিরুল ইসলাম বলেন, তাদের এই ভালোবাসা এখন অনেকের কাছেই একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। তিনি মাসুরাকে নিয়ে জীবন পাড়ি দিতে চান। তবে পেশায় ভ্যানচালক। নিজের কোনো বাস্তুভিটা নেই। মেয়েটাও প্রায় সব সময় অসুস্থ থাকে। তার ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু ভ্যান চালিয়ে যা উপার্জন করেন তা দিয়ে সংসারই চলে না। এখন কিভাবে মেয়ের পড়াশোনা করাবেন এবং চিকিৎসা করাবেন তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। মাথার ওপর যেই আশ্রয় আছে সেটিও পরের দেওয়া। এখন তারা এই জায়গা ছেড়ে দিতে অনবরত চাপ দিচ্ছেন। তাই পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।  

যদিও এরই মধ্যে রাজশাহী জেলা প্রশাসক তাদের বিষয়টি জানতে পেরে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তাদেরকে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ডেকে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এছাড়া শিগগিরই বাড়িও করে দেবেন বলে জানিয়েছেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক।

অন্যদিকে মাসুরা বেগম জানান, তিনি এশিয়ার সর্ব ক্ষুদ্রাকৃতির মা। অথচ আজও তার কোনো স্বীকৃতি মেলেনি! এর ওপর অভাব-অনটনের কষাঘাতে ভালো নেই তিনি ও তার পরিবার। তাদের কষ্টের কথা জেনে জেলা প্রশাসক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে নিজের স্বীকৃতি, ভ্যানচালক স্বামীর কর্মসংস্থান নিয়ে তিনি এখনও উদ্বিগ্ন। এর ওপর মেয়ের চিকিৎসা এবং পড়ালেখার খরচও রয়েছে। কীভাবে এত সবের যোগাদন দেবেন, তারা তা জানেন না। এই অবস্থা এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকায় ‌‘মা’ মাসুরা সরকার প্রধানের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। তার প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী সব জানলে তার এই দুঃখের জীবন হয়তো শেষ হবে।



বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, তার বিষয়টি জানতে পেরে এরই মধ্যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ডেকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে নগদ ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নে তাদের মাথা গোঁজার জন্য বাড়ি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এক থেকে দুই মাসের মধ্যে তাকে বাড়ি করে দেওয়া হবে।  

এছাড়া তিনি এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মা হয়ে থাকলে অবশ্যই তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।