কুষ্টিয়া: স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয় কুষ্টিয়ার কুলফি মালাই। কাঁধে লাল কাপড়ে মোড়া বড় পাতিল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে কুলফি বিক্রি করেন আবুল হোসেন।
কুলফি তৈরি করতে সাদামাটা রেসিপি লাগলেও এটির স্বাদের কারণে বেশ জনপ্রিয়। এ মালাইকে ঘিরে চলে অনেকের জীবিকা।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া এবং শিলাইদহ ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় দেখা যায় কুলফি তৈরির কারিগরদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়ির নারীদের দায়িত্ব কুলফি বানানো আর বাড়ির পুরুষদের দায়িত্ব সেগুলো বাজারে বিক্রি করা।
কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের উত্তর কয়া এলাকা। এ গ্রামের অনেকেই রয়েছেন এ কুলফি তৈরির পেশায়।
সেলিনা খাতুনের বাড়ি উত্তর কয়া এলাকায়। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি কুলফি মালাই তৈরি করেন। গরুর দুধ, চিনি, এলাচ, গরম মসলা দিয়ে তৈরি করেন সুস্বাদু কুলফি।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, কুলফি বানাতে তেমন কিছু ব্যবহার করি না। গরুর দুধ, এলাচ, গরম মসলা, কিসমিস দিয়ে কুলফি বানানো হয়। কুলফি তৈরির জন্য প্রথমে কড়াইটা তেল দিয়ে গরম করে নিতে হবে। তারপর কড়াইতে চিনি ভেজে নিয়ে দুধ জাল দিতে হবে। ১০-১২ ঘণ্টা দুধ জাল দেওয়ার পর যখন দুধ খির হয়ে যায়, তখন চুলা থেকে নামিয়ে চিনি, এলাচ, মসলা মিশিয়ে টিনের কৌটায় ভরা হয়। পরে কৌটাগুলো বরফের মধ্যে রাখা হয়। এভাবে তৈরি হয় কুলফি মালাই। যা ছোট বড় সবারই প্রিয়।
তিনি আরও বলেন, গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা গরুর দুধ কিনে আনি। আবার অনেকে বাড়িতে এসে দুধ দিয়ে যান। প্রতিদিন ৩০-৩৫ লিটার দুধ জাল দিয়ে ১২-১৫ লিটার করি। এ দুধ দিয়ে আমরা ভেজালমুক্ত কুলফি বানাই। ৩০ লিটার দুধ থেকে প্রায় ১২০-১৩০ কৌটা কুলফি হয়। এতে দুধ, চিনি, গরম মসলাসহ সব মিলিয়ে হাজার দুই টাকা খরচ হয়। সেই সঙ্গে দিনে বরফ কিনতে যায় শতেক তিনশ’ টাকা। আর বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকার কুলফি। ফলে দিনে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা লাভ থাকে। কৌটার সাইজের ওপর কুলফির দামে হেরফের হয়। তবে স্বাদ ও মানে কোনো পার্থক্য নেই।
সেলিনা খাতুন ও তার পুত্রবধূ বাড়িতে এ মালাই তৈরি করেন আর সেলিনার স্বামী আবুল হোসেন সারাদিন সেগুলো বিক্রি করেন।
সেলিনাদের কাছে দুধ বিক্রি করেন শাহেরা খাতুন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি বাড়িতে গাভি পালন করি। যে দুধ পাই, তা সেলিনাদের বাড়ি নিয়ে আসি প্রতিদিন। তারা আমাদের কেজি প্রতি ৬০ টাকা দরে দুধ কিনে থাকে। এছাড়া আরও অনেকে তাদের কাছে দুধ বিক্রি করে। সেসব দুধ দিয়ে সেলিনারা কুলফি বানায়।
পলাশ নামে স্থানীয় এক কলেজছাত্র বাংলানিউজকে বলেন, আমি কুলফি খুবই পছন্দ করি। তাই কীভাবে এটা তৈরি করা হয়, তা দেখতে এসেছি। এটা খেতে খুবই সুস্বাদু।
কুমারখালীর শিলাদহ এলাকার কুলফি বিক্রেতা রশিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, গরমের সময় কুলফিটা বেশি বিক্রি হয়। কৌটার আকার অনুযায়ী এর দাম। ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত। কুষ্টিয়া জেলা জুড়েই কুলফি বিক্রি করি। আর অনেক সময় অর্ডার থাকলে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বানিয়ে দিয়ে আসি বা ডেলিভারি দিয়ে আসি। এ মালাই বিক্রি করেই সংসার চলে।
শিলাইদহ ঠাকুরবাড়ি এলাকার কুলফি বিক্রেরা আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ৫০ টাকার কুলফি মালাইয়ে দুধের সর দেওয়া থাকে। আর কম টাকারগুলোতে থাকে না।
সম্প্রতি পাশের জেলা রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়ায় ফকির লালন শাহের মাজারে আসা রিয়াদ নামে এক যুবক বাংলানিউজকে জানান, প্রতিবছর আমি লালন মেলায় আসি এবং এখানকার বিখ্যাত কুলফি মালাই কিনে থাকি। কুলফি খেতে খুব মজা লাগে।
কুলফি বিক্রেরা আবুল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বাড়ি থেকে আমরা নিজেরাই কুলফি তৈরি করে হেঁটে হেঁটে স্কুল, কলেজ, বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় বিক্রি করি। কুলফির মান নিয়ে কোনো আপোস করি না আমি। কারণ সবচেয়ে ভালোটা আমি তৈরি করি বলেই আমার মালাই সবার থেকে সেরা। অনেকেই আছে, দুধে পানি মিশিয়ে কুলফি বানায়। আর সেই কুলফি কম টাকায় বিক্রি করে। তাদের কারণে আমাদের সমস্যা হয়।
তিনি বলেন, ভালো কুলফির কদর সব সময় আছে। আমি ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় কুলফি বিক্রি করি অর্ডারের মাধ্যমে। ভারতেও একবার কুলফি মালাই দিয়েছি। দিনে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার কুলফি বিক্রি করি। যেখানে দুই-তিন হাজার টাকা মতো লাভ হয়।
তিনি আরও বলেন, শীতকালে কুলফি কম বিক্রি হয়। সরকার যদি আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়, তাহলে কুলফি শিল্পটা আরও বিস্তার লাভ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২২
এসআই