ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অগ্নিসন্ত্রাস: দগদগে ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকাদের আর্তনাদ

মহিউদ্দিন মাহমুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০২২
অগ্নিসন্ত্রাস: দগদগে ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকাদের আর্তনাদ আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নি সন্ত্রাসের আর্তনাদ: বিএনপি-জামাতের অগ্নি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠান

ঢাকা: তীব্র মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন ২০১৩-২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় নিহতদের স্বজন এবং অগ্নিদগ্ধ আহতরা। শরীরে ও মনে দগদগে ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা সেই মানুষগুলোর আর্তনাদে এখনো ভারী হয় বাতাস।

বিএনপি-জামায়াতের সেই আন্দোলনের সময় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি চলন্ত বাসে হামলা করে অগ্নিসন্ত্রাসীরা। সমুদ্র সৈকত ঘুরে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সেই বাসে কক্সবাজার ফিরছিলেন নুরুজ্জামান বাবলু। বাসে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান নুরুজ্জামান বাবলু ও তার কিশোরী কন্যা মাইশা। গুরুতর আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যান নুরুজ্জামানের স্ত্রী মাফুয়া বেগম। আজো তার শরীরে অগ্নি দহনের জ্বালা, মনে রয়ে গেছে চোখের সামনে স্বামী-সন্তানকে আগুনে পুড়ে মারা যেতে দেখার দগদগে ক্ষত, চোখে অবিরাম কান্না। এক বুক দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদ নিয়ে বেঁচে আছেন মাফুয়া বেগম।

রোববার (০৬ নভেম্বর) রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নি সন্ত্রাসের আর্তনাদ: বিএনপি-জামাতের অগ্নি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে নিদারুণ কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার সেই দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন মাফুয়া বেগমসহ অগ্নিসন্ত্রাসে কয়েকজন নিহতের স্বজন এবং দগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা কয়েকজন।



অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।

কাঁদতে কাঁদতে মাফুয়া বেগম বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি না, আমরা রাজনীতি বুঝি না। পেটের দায়ে আমাদের স্বামী-সন্তানদের রাস্তায় বেরুতে হয়। কেন আমরা এভাবে অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হবো? আমার সন্তান মাইশা কী অপরাধ করেছিল? আমার স্বামী কী অপরাধ করেছিল? আমি আমার সন্তানের ডাক আট বছর থেকে শুনতে পাই না। মাইশা আমাকে আর মা বলে ডাকে না!’

সেদিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া এবং চোখের সামনে স্বামী-সন্তানকে আগুনে পুড়ে মারা যেতে দেখার দুঃসহ স্মৃতির কথা তুলে ধরে মাফুয়া বলেন, ‘প্রাণে বাঁচাতে আমার স্বামী আমাকে জানালা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আমি আমার সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি, স্বামীকে বাঁচাতে পারিনি। চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। এখনো আমার বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে সেই আগুন জ্বলে। ’



‘আমি এখনো সারারাত ঘুমাতে পারি না। আমার চোখের সামনে সেই আগুনের শিখা দেখতে পাই। আমার মাইশা আম্মু বলে যে চিৎকার দিয়েছিল, সেই ডাক এখনো আমার কানে বাজে। আমি ঘুমাতে পারি না। সারারাত আমি ঘুমাতে পারি না। আমরা কী অপরাধ করেছিলাম!’

মাফুয়া বেগমের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে জাতীয় জাদুঘরের মিলতায়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেককে অশ্রুসজল হতে দেখা যায়।

মাফুয়া বেগমের মতো এই অনুষ্ঠানে স্বজন হারানোর বেদনা কিংবা শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে নিদারুণ কষ্টে বেঁচা থাকা আরও কয়েকজন তাদের দুঃসহ যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেন। এছাড়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময় সামরিক বাহিনীতে নিহতদের কয়েকজন স্বজন তাদের বেদনার কথা তুলে ধরেন।



ককটেল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত চোখ নিয়ে বেঁচে থাকা শিক্ষার্থী অন্তু বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা শিশুরা কী অপরাধ করেছিলাম। আমরা কেন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার। পেট্রোল বোমা-ককটেল মেরে এটা কী ধরনের রাজনীতি। আমরা একটা সুষ্ঠু সুন্দর দেশ চাই। সুষ্ঠু সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখি। ’

স্বামী হারানো বীনা সুলতানা বলেন, আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে ডাকতে পারে না। কী অপরাধ করেছিল আমার স্বামী? সহিংসতায় জড়িতদের দৃষান্তমূলক শাস্তি চাই।

নিহত পুলিশ সদস্য বাবলু মিয়ার স্ত্রী বলেন, আমি স্বামী হারিয়েছি, আমার সন্তান বাবা হারিয়েছে। আর কেউ যেন স্বামী হারা-সন্তান হারা না হয়।

শাহবাগে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত নাহিদের মা রুনি বেগম বলেন, আমার সন্তানের লাশ আমি দেখতে পারিনি। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) আমার মা, আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।

যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় গুরুতর আহত হন সালাউদ্দিন ভূইয়া। শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে ঝলসে যায় পুরো মুখ। আগুনে পুড়ে তার চেহারা বিকৃত হয়ে যায়।



সালাউদ্দিন ভূইয়া আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আগে আমার চেহারা দেখতে সুন্দর ছিল। এখন আমাকে দেখে মানুষ ভয় পায়। আমার পাশে সিটে মানুষ ভয়ে বসতে চায় না। কেউ কাজে নেয় না। আগে যেখানে যেতাম চাকরি হয়ে যেতো।

নিজের চোখের সামনে আগুনে পুড়ে মারা যায় কার্ভাডভ্যানচালক রমজান আলীর সন্তান মনির হোসেন। রমজান আলী বলেন, আমার ছেলের কী অপরাধ! আমরা তো কোনো রাজনীতি করি না। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। পেটের দায়ে, এক মুঠো ভাতের জন্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া গাড়ি চালাই। কী অপরাধে আমার সন্তানকে পেট্রোল বোমা মেরে হত্যা করা হলো? তিনি তার সন্তানের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ছোট একটি নাটিকার মাধ্যমে অগ্নিদগ্ধদের যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় নিহত ও আহত অগ্নিদগ্ধদের ওপর এবং যানবাহনের অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০২২
এমইউএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।