ফেনী: দুয়ারে কড়া নাড়ছে আরেকটি ফুটবল বিশ্বকাপ। ক্রীড়া প্রেমীদের মধ্যে বিরাজ করছে নানা রকম উৎসাহ- উদ্দীপনা।
তেমন এক দুর্ভাগা আবদুল মতিন। তার বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞাঁ উপজেলা সিন্দুরপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে। প্রিয় দল আর্জেন্টিনার পতাকা উড়াতে গিয়ে চিরতরে হারিয়েছেন নিজের চার হাত-পা। পরিশ্রমী, কর্মঠ মতিনের ছিলো সাজানো গোছানো ব্যবসা। সুস্থ-সুন্দর শারীরিক গঠনাকৃতির মতিনের এখন কিছুই নেই। বেঁচে আছেন আত্নীয় ও প্রতিবেশীদের সাহায্য সহযোগীতায়।
এত কিছুর পরেও কমেনি ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ। খামতি হয়নি টিম আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসারও। তবে তার অনুরোধ, ফুটবল উন্মাদনায় এমন কিছু যেন না হয়, যার রেশ টানতে হবে সারা জীবন।
মতিন বলেন, ২০১৪ সালের মার্চ মাসের ২৮ তারিখ। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগের ঘটনা। লক্ষ্মীপুর শহরের আজিম শাহ মার্কেটের তিন তলা ছাদের উপরে এলমুনিয়াম রডের মাধ্যমে পতাকা টানাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিদ্যুতের প্রধান সঞ্চালন লাইনের সাথে লেগে যায় এলমুনিয়ামের রডটি। মূহুর্তেই ছিটকে পড়ি একটি দেয়ালের উপর। আর হুশ ছিলো না।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে। আইসিইউতে রাখা হয়েছিলো ২৭ দিন। সাড়ে তিন মাস চিকিৎসা চলছে। ইনফেকশান হয়ে যাওয়ায় হাত-পা গুলোকে রক্ষা করা যায়নি কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। পুরো চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ব্যবসা, দোকান সব শেষ হয়েছে। সব হারিয়ে একদম শূণ্য।
গ্যালারিতে বসে মেসিদের খেলা দেখার স্বপ্ন:
মতিন বলেন, নিজের পছন্দের দলের প্রতি উন্মাদনা দেখাতে গিয়ে আজ আমি সব হারা। বেশী কিছু স্বপ্ন নাই; গ্যালারিতে বসে প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে চাই। মেসিদের একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। আমি চাই একদিন মেসি আমাকে দেখতে আসবে। আর্জেন্টিনার শৈল্পিক খেলোয়াড়রা কাঁধে হাত রেখে বেঁচে থাকার সাহস জোগাবে।
তবুও ছেড়ে যায়নি প্রিয়তমা:
মতিন হাত-পা হারিয়ে যখন শয্যাশায়ী তখনও তার প্রেমিকা ফাতেমা তাকে ছেড়ে যায়নি। অনিশ্চিত একটি জীবন জেনেও অভিভাবকদের অমতেই বিয়ে করেন মতিনকে। বিয়ে করে প্রিয় মানুষের সেবার কাজে লেগে যান। মতিন বলেন, তাদের দু’জনের মধ্যে ভালবাসা সম্পর্ক ছিলো। দূর্ঘটনার পরে মনে করেছিলাম ফাতেমা হয়তো আর সম্পর্কটা রাখবে না। কিন্তু ঘটলো উল্টো। এখন খাওয়া, কাপড় পরিষ্কার করা, পস্রাব-পায়খানা থেকে শুরু করে সব কাজ স্ত্রী করেন।
তাদের সংসার আলো করে জান্নাতুল ঝুমুর নামের ৬ বছর বয়সী একটা কন্যা সন্তানও আছে। ফাতেমা বলেন, মানুষটাকে ভালবাসি, ভালবাসার মানুষকে ভালবেসে সেবা করে যেতে চাই।
বেশী উন্মাদনা নয়
আবদুল মতিন বলেন, খেলা হবে মাঠে। আমরা যে যেখানে আছি সে অবস্থানে থেকে খেলা দেখা ও উপভোগ করা উচিৎ। বেশী উন্মাদনা দেখানো ঠিক নয়, এমন কোন কাজ করা ঠিক হবে না যার রেশ টানতে হবে।
মতিন আরও বলেন, আমাকে দেখে যেন মানুষ এই শিক্ষা নেয় যেন বেশী উন্মাদনা নয়। জীবন যেন ঝুঁকিতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের সকলের সহযোগিতায় মতিন বেশ হাসি খুশিতেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সাইমুম ফারাবী নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, এলাকার মানুষ অনেক সহযোগিতা করে মতিনকে। নামাজ পড়া, দোকানে চা খাওয়া কিংবা বাজার করতে যাওয়া; সব সময় এলাকার মানুষ মতিনের সাথে আছে। এলাকার মানুষগুলোই যেন মতিনের হাত-পা।
মতিনের চাচা আবুল কাশেম বলেন, দূর্ঘটনার পর থেকে মতিন কিছু করতে পারে না। সমাজের সকলে মিলে মতিনকে সহায়তা করছে। এর ফলে মতিন ভাল আছে।
মতিনের শ্বশুর আবদুস সোবহান বলেন, যাই হোক মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখানেই মেয়ের বিয়ের কথা উপরওয়ালা লিখে দিয়েছেন। আমাদের মেয়ে মতিনকে অনেক সহায়তা করেন
মতিন বলেন, ভাই, বোন, কিছু বন্ধু ও এলাকাবাসীর সহযোগীতায় কোন রকম টিকে আছে সে। সবাই পাশে না থাকলে আরও অনেক কষ্ট হতো।
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর:
হাত-পা না থাকলেও মতিন থেমে থাকার মানুষ না। এলাকার তরুণ যুবক নোমানের সহযোগীতায় একটি ফেসবুক পেজ খুলে নিয়মিত ভিডিও তৈরী করছেন। মতিন বলেন, বিনা পারিশ্রমিকে নোমান তার ভিডিও তৈরী করে দেয়। বিগত ৮ বছর যাবত এ সহযেগিতা অব্যাহত আছে। মতিন বলেন, আমি চাই আমার ব্লগটি মানুষ দেখুক। কিছু করতে না পারলেও এখান থেকে টুকটাক আয় করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ভিক্ষা না করে চলতে পারব।
মতিনের ফেসবুক লিংকটি হলো www.facebook.com/IamMotinArgentina/ এই পেজটি নিয়মিত দেখার জন্য মতিন সবার কাছে অনুরোধ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২২
এসআইএ