নিউইয়র্ক: বড়দিনের আনন্দের রেশ না কাটতেই যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ লাখ বেকার মানুষের জীবনে অমানিশা নেমে এসেছে। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে দিয়ে আসা বেকার-ভাতা ও ইন্স্যুরেন্স প্রাপ্তির সুবিধা শনিবার থেকে স্থগিত করা হয়েছে।
বেকার-ভাতা সুবিধা স্থগিতের সিদ্ধান্ত শুধু গরিবদের জন্যই নয়, উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রেও ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে।
আগামী বছর কংগ্রেসে শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক যুদ্ধের দামামায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে জরুরি উদ্যোগের তাগিদ সত্ত্বেও হঠাৎ স্থগিত হয়ে গেলো বেকারকালীন সুবিধাসমূহ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের নগদ অর্থ সহায়তায় গড়ে মাসিক ১ হাজার ১ শ ৬৬ ডলার জরুরি বেকার-ভাতা ভোগী পরিবারগুলোকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে এখন।
আইভিলিগে পড়ালেখা করা আইনজীবি ও কংগেসম্যান মাইকেল ম্যাকনাল্টি’র সাবেক চিফ অব স্টাফ এবং কংগ্রেশনাল ও গভর্নমেন্ট রিলেশনে ২৩ বছর অভিজ্ঞ ডেভিড টোরিয়ান সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, অসুস্থ্য মায়ের সেবায় নিয়োজিত বোনকে সাহায্য করতে কিছুদিন তিনিও অবসরে ছিলেন। কিন্তু অবসর শেষ করলে জানতে পারেন, অভিজ্ঞতা থাকলেও ৪৯ বছর বয়সই তার চাকরিতে ফেরার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তার চাকরিপদ পূরণ হয়ে গেছে।
ডেভিড টোরিয়ান আরও জানান, চাকরির সাক্ষাৎকারে তিনি ‘ওভার কোয়ালিফাইড’ হওয়ার কারণে তিনি এখন আর কাজ পাচ্ছে না। এ কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চাকরি খুঁজছেন তিনি। এটা তার জন্য ভীষণভাবে বিব্রত। তিনি ব্লু কলার চাকরি করতে চাইলেও পাচ্ছেন না। বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় বাসাও বদল করতে হয়েছে তাকে।
হোয়াউট হাউসের ইকোনমিক এডভাইজারস কাউন্সিল বলেছে, বেকার-ভাতা সুবিধা বাতিলের সঙ্গে ২০১৪ সাল নাগাদ আরও ২ লাখ ৪০ হাজার লোক চাকরি হারাবে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের আরও ১৯ লাখ মানুষ আগামী জুনের শেষ নাগাদ তাদের স্ব-স্ব রাজ্য সরকারের দেওয়া সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে।
বাজেট সমঝোতায় এই বেকার-ভাতা ও সুবিধাদি স্থগিত করা হলেও কংগ্রেসের নতুন কিছু শুরু করার সদিচ্ছার বিষয়টি এখনও পরিস্কার নয়।
সিনেট মেজরিটি নেতা ডেমোক্রেট হ্যারি রীড সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বেকার-ভাতা সুবিধা পুনর্বিবেচনায় আগামী ৬ জানুয়ারির আগে সিনেটে জরুরি ভোটেরও সুযোগ নেই।
শনিবার থেকে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ লাখ মানুষ বেকার সুবিধা বঞ্চিত হবে। এর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ায় ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ তাদের অর্থ সাহায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, আগামী বছর এ সংখ্যা ৫ লাখে পৌঁছবে।
গত ১২ মাসে এই রাজ্যে বেকার-ভাতা বাবদ সাড়ে ৪শ’ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছে, যার অনেকটাই স্থানীয় অর্থনীতিতে ফেরত এসেছে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিউইয়র্কের ১ লাখ ২৭ হাজারেরও বেশি বেকার মানুষ এই সুবিধা বঞ্চিত হবে। এছাড়া, জনসংখ্যার দিকে থেকে ১১তম বৃহৎ রাজ্য নিউজার্সিতেও ৯০ হাজার মানুষ বেকার-ভাতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে বেকারত্ব কমলেও কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে ব্যবহারের গাড়ী কেনার ক্ষেত্রেও ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক মন্দায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ কমিউনিটিগুলো হঠাৎ করেই আবার নগদ অর্থের অভাবের মুখোমুখি হবে। এর পরিসংখ্যানে প্রতি একটি পদে চাকরির জন্য তিনজন প্রতিযোগী থাকবে।
প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমল থেকে শুরু হওয়া এই বেকার-ভাতা সুবিধায় অর্থনৈতিক মন্দায় চাকরিহারা এবং নতুন চাকরি না পাওয়া ব্যক্তিরা নিজস্ব রাজ্য সরকার ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকেও এই সুবিধা ভোগ করতেন।
এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, কংগ্রেসের নতুন বছরের প্রথম কাজই হবে `এটাকে শুধরানো’। তবে, তার কাছে দ্রুত কোনো সমাধান নেই।
চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে আলোচনা করে ৬ মাসের বেশি চাকরিহীনদের বেকার-ভাতা সুবিধা স্থগিতে সম্মত হয় ওবামা প্রশাসন।
যদিও প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, এই আর্থিক সুবিধা প্রায় সাড়ে ১১ মিলিয়ন (১১. ৪) মানুষকে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং ১৭ মিলিয়ন শিশু এই সিদ্ধান্তের উপকার পেয়েছে।
গত ২০০৮ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সুবিধায় সরকারের ব্যয় হয়েছে মোট ২শ’ ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক মন্দার ধরন অনুযায়ী ছাটাইকৃত কর্মীরা নিজ রাজ্যের প্রাথমিক ২৬ সপ্তাহসহ সর্বোচ্চ ৯৯ সপ্তাহ পর্যন্ত এই আর্থিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ পায়। রাজ্য বিবেচনায় এই সুবিধা প্রাপ্তির সময়সীমা ৭৩ সপ্তাহ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। কংগ্রেশনাল বাজেট দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী আতিরিক্ত ৪৬ সপ্তাহ পুনঃসংযোজনে ২০১৪ সাল নাগাদ মোট ১ হাজার ৯শ’ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হতো।
মিশিগানের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান স্যান্ডার লেভিন ও মেরিল্যান্ডের ক্রিস ভ্যান হ্যলেন সম্ভাব্য ‘খামার’ বিলের ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত এই সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব এনেছিলেন। কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
এদিকে সিনেটর জ্যক রিড, ডীন হেলার ৩ মাসের মেয়াদ বৃদ্ধিতে একই ধরনের একটি বিল এনেছেন এবং সিনেট রিপাবলিকান নেতা হ্যারি রীড প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি এটি আলোচনায় আনবেন, কিন্তু কংগ্রেসে বিবেচনায় এতে মেয়াদবৃদ্ধির কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কংগ্রেসের স্পিকার জন বোয়েনার এরই মধ্যে মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন যে, এই অর্থের যোগান অগ্রিম হতে হবে এবং পাশাপাশি অর্থনীতিকে আবারও সামনে এগিয়ে নিতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য, হোয়াইট হাউস এখনো তেমন গ্রহণযোগ্য কোনো পরিকল্পনা দিতে পারেনি।
অন্য রিপাবলিকানদের কাছে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা আরও বেশি। তাদের অনেকেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নির্দেশক ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। বেকারত্বের হারও ৭ ভাগ কমেছে এবং আরও কমে আসবে। তাই বেকার-ভাতা সুবিধার মেয়াদ বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
‘বেকার ভাতা পেতে, তাদেরকে চাকরি খুঁজতে হবে’-কেন্টাকির বিতর্কিত টি পার্টির সিনেটর ৠান্ড পল এ যুক্তি দিয়ে বলেন, এই সরকারি সুবিধাগুলো বেকারত্ব দূর করার চেয়ে আরও বাড়াতে সাহায্য করেছে। এছাড়া, চাকরি সন্ধানকারীদের ‘বেশী বেতনে’ চাকরি খোঁজার সুযোগ করে দিচ্ছে। এই সুবিধা না পেলে তারা হয়তো স্বল্প বেতনের চাকরিই গ্রহণ করবে, যা বেকারত্বের হার কমিয়ে আনবে।
এদিকে, কংগ্রেশনাল বাজেট দপ্তরের হিসাবে বেকার সুবিধা প্রাপ্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দিলে প্রবৃদ্ধি হার বাড়বে ০ দশমিক ২ ভাগ এবং ফুল টাইম চাকুরেদের সংখ্যা আগামী বছর নাগাদ ২ লাখ বাড়বে। তবে এজন্য সরকারকে বাড়তি ঋণের বোঝা নিতে হবে।
বর্তমানে ৪০ লাখ মানুষ দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্বে ভুগছে। বেকারত্ব গড়ে ৩৭ সপ্তাহ থাকছে, যা রাজ্য সরকারের প্রদত্ত বীমার চেয়ে ২ মাস মাত্র বেশি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর