নিউইয়র্ক: বাংলাদেশের জেনারালাইজড সিস্টেম প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা ও গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে তুমুল বিতর্কে টালমাটাল হয়েছে বোস্টনের হার্ভার্ড ইউনির্ভাসিটি।
বোস্টনে শনিবার বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারে দুই দেশের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক পর্যায়ের এই বিতর্কে দুই পক্ষে ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, ডেমোক্র্যাট দলের প্রভাবশালী সদস্য কংগ্রেসম্যান জর্জ মিলার, রাষ্টদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা, আইএলও এবং হিউম্যান রাইটস নেতা, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ দুদেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
সেমিনারে মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব তুলে ধরেন। জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তাদের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রায় শত ভাগ সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে সরকার।
কংগ্রেসম্যান জর্জ মিলারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আগের দিন ওয়াশিংটন বৈঠকে তিনিই বলেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নে ‘মিরাকল’র গল্প।
তোফায়েল আহমেদের অসাধারণ দৃঢ়চেতা ও নেতৃত্ব সুলভ বক্তব্যে পুরো সেমিনার কক্ষ করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
তোফায়েল ড্যান মজীনাকে উদ্দেশ করে বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি, এমনটা যে হওয়া স্বাভাবিক, সেটা নিজেই উপলব্ধি করেছি।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, মার্কিন নীতি-নির্ধারকদেরকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন এবং তিনি আশা প্রকাশ করেন, মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিতে ইতিবাচক ভূমিকাই রাখবে।
বাংলানিউজকে বাণিজ্যমন্ত্রী আরো জানান, এ পর্যন্ত তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক ও ম্যাসাচুসেটসের প্রায় ডজন খানেক কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা কেউই নেতিবাচক কোনো কথা বলেননি।
‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি অব বাংলাদেশ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক এই সেমিনারটির আয়োজন করে হার্ভার্ড ইউনির্ভাসিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট ও আইএসডিআই।
দিনব্যাপী সেমিনারের দুটি পর্যায়ে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডেমোক্র্যাট দলের সিনিয়র সদস্য কংগ্রেসম্যান জর্জ মিলার ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা।
এ সময় তারা বাংলাদেশের পোশাক কারখানার সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা, শ্রমিকের মজুরি স্বল্পতা এবং শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের হত্যা-নির্যাতনসহ নানা নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে দুই পক্ষ বিতর্কে জড়িয়ে যায়।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকে দেওয়া ১৬টি কঠিন শর্ত রাতারাতি শতভাগ পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু, প্রায় ৯৮ ভাগই পূরণ হয়েছে।
তিনি ইউএস-এইড ও ইউকে-এইডের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বিপাকে ফেলেন প্রতি পক্ষকে।
বিতর্কের এক পর্যায়ে এক ধরনের জেদ প্রকাশ করে কংগ্রেসম্যান জর্জ মিলার বলেন, আমরাও একমসয় ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিতে চাইনি। শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে চেয়েছি। কিন্তু আমরা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্ভয়ে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিতে হবে এবং জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব।
তিনি গার্মেন্টস মালিকদের নিপীড়নের কথা তুলে ধরে বলেন, মালিকরা শ্রমিকদের ওপর পরিকল্পিতভাবে নিপীড়ন চালাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান না হলে জিএসপি সুবিধার কথা ভাবা সম্ভব হবে না।
জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, যারা ওয়াশিংটনে এসে শুনানি করেন, তারা কেউ শ্রমিকদের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়; তারা বহিরাগত।
তিনি বলেন, এটাও জরিপে বেরিয়ে এসেছে, শ্রমিকরা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি চায়।
এতে আরো ক্ষিপ্ত হন কংগ্রেসম্যান জর্জ মিলার।
এরপর দর্শক সারি থেকে ‘অভিযোগগুলো নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা বিবেচনা করবে, নাকি বাংলাদেশকে শাস্তি দেবে’, এমন প্রশ্নে আরো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন জর্জ মিলার।
এদিকে, আরেক পর্বে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বাংলাদেশের ব্যাপারে চরম কঠোর অবস্থান নিয়ে বলেন, ৯৮ ভাগ বা ৯৯ ভাগ নয়, সম্পূর্ণ শতভাগ শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। নইলে বাংলাদেশের উন্নয়ন বিপন্ন হবে। বাংলাদেশ বিশ্বে রফতানিকারক হিসেবে তাদের অবস্থান হারাবে। অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হবে।
এ সময় ড্যান মজীনার বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাবকে চূড়ান্তভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ের মনে হলে পুরো হল জুড়েই গুঞ্জন শোনা যায়, যিনি কয়েক দিন আগেও বাংলাদেশকে নিয়ে ইতিবাচক বাক্যে মুখে ফেনা তুলেছেন, তিনি হঠাৎ করেই কেন এমন বাংলাদেশ বিরোধী হয়ে উঠলেন!
এর সূত্র ধরে মধ্যাহ্ন বিরতিতে করিডোরে বিক্ষুব্ধ এক ইউরোপীয় প্রতিনিধি ড্যান মজীনাকে তার বক্তব্য ও মনোভাবের প্রতিবাদ জানিয়ে জানতে চান, কেন তিনি এমন আচরণ করলেন? এটা কোনো কূটনীতিকসুলভ আচরণ নয়!
দিনব্যাপী সেমিনারে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি অবাঙালি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশি কূটনীতিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের নেতা, লেবার ও মানবাধিকার কর্মীসহ হার্ভার্ডের ছাত্র-শিক্ষকরা অংশ নেন।
সেমিনারে বিতর্কের এক পর্যায়ে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর শ্রীনিভাস রেড্ডি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও বাংলাদেশের ব্যবসায়িক নেতাদের উপস্থাপিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তকে সমর্থন করে বলেন, বাংলাদেশে তারা আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছেন, মাত্র শতকরা ২ ভাগ ভবনের অবকাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। ৯৮ ভাগই এ সমস্যামুক্ত ও নিরাপদ।
সেমিনারে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের জিএসপি বিষয়ক আন্তর্জাতিক ব্যুরোর দক্ষিণ এশীয় প্রধান মাইকেল ডোনাভান, যুক্তরাষ্ট্রের লেবার ম্যানেজমেন্ট আরবিট্রেটর আরনল্ড জ্যাক ও প্রতিনিধি মিস সেলেসটে ড্রেক, ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়ামের প্রতিনিধি স্কট নোভা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়ে ড্যান মজীনাকে সমর্থন করেন।
তবে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনেটেটিভের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মারা বার জিএসপির বিষয়ে কংগ্রেসের নবায়নের কথা তুলে ধরে বলেন, কেবল এ সব অভিযোগ নয়, আরো অনেক কিছু মিলিয়েই জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়েছে।
তিনি বলেন, দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্কের সঙ্গে জিএসপিকে এক করে দেখা ঠিক হবে না।
এদিকে, জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত তৌফিক আলী চমৎকারভাবে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, রাষ্ট্রদূত থাকাকালে সব সময়ই বাংলাদেশের একজন হয়ে দারুন বক্তব্য রেখেছেন ড্যান মজীনা। তবে এখন সত্যিকার দেশপ্রেমিক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়কমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
হার্ভার্ড ল স্কুলের প্রফেসর জন কেলচি এবং আয়োজকদের একজন ইকবাল ইউসুফ পৃথকভাবে দুটি পর্বে সেমিনারের সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪