লন্ডন: পরিবার-বিচ্ছিন্ন প্রবাসীদের আবেগ অনুভূতি বা কষ্ট নয়, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ হোম অফিসের ‘বিতর্কিত’ ফ্যামিলি ভিসা আইনের পক্ষেই রায় দিলো ব্রিটেনের কোর্ট অব আপিল। তার মানে, এখন থেকে নন-ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে স্বামী বা স্ত্রীকে আনতে হলে স্পন্সরের সর্বনিম্ন বার্ষিক আয় ১৮ হাজার ৬০০ পাউন্ড থাকতেই হবে।
শুক্রবার কোর্ট অব আপিল হোম অফিসের নতুন ফ্যামিলি ভিসা আইন বহাল রাখার পক্ষে রায় দেয়। এ রায়ের ফলে হোম অফিসের অপেক্ষমান তালিকায় থাকা নন-ইউরোপিয়ান প্রায় ৪ হাজার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিও আছেন।
২০১২ সালে ফ্যামিলি ভিসার ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীকে আনতে হলে স্পন্সরের নূন্যতম ১৮ হাজার ৬০০ পাউন্ডের বার্ষিক আয় থাকতে হবে, এমন নিয়ম চালু করে হোম অফিস। আগে এই টাকার পরিমাণ ছিলো ১৩ হাজার পাউন্ড। নতুন আইনে আরো যুক্ত করা হয়, যদি কোনো দম্পতির এক সন্তান থাকে তবে এই অংক ২২ হাজার ৪০০ পাউন্ডে দাঁড়াবে। পরবর্তী প্রতি সন্তানের ক্ষেত্রে ২ হাজার ৪০০ পাউন্ড করে যুক্ত হবে মূল আয়ের সঙ্গে।
এ নিয়ম চালু হওয়ার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠে সবখানে। ২০১২ সালে জুলাই মাসে চালু হওয়া হোম অফিসের এই কঠোর ভিসা নিয়মকে এম এম আবুল জাজিদ ও শাবানা জাবেদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
আবেদনকারীর পক্ষে জারিকৃত রুলে হাইকার্টের বিচারক ব্লেইক বলেন, হোম অফিসের এই ফ্যামিলি ভিসা নিয়ম আইন বহির্ভূত না হলেও এটি বৈষম্যমূলক এবং পরিবার ও শিশুদের প্রতি অন্যায্য। বৈষম্যমূলক এই আইন বাতিলের এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই উল্লেখ করলেও ভিসা আবেদনকারীর আয়সীমা ১৮ হাজার ৬০০ পাউন্ড থেকে নামিয়ে ১৩ হাজারে নিয়ে আসতে হোম সেক্রেটারির প্রতি রুলে সুপারিশ করা হয়।
ব্লেইক তার রুলে আরো বলেছিলেন, হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টের আর্টিকেল-৮ এ একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। আবেদনকারীর আয়ের নূন্যতম সীমাকে ভিসা আবেদনের শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় মন্তব্য করে বিচারক আগের নিয়মে থাকা আবেদনকারীর আয়সীমা ১৩ হাজার পাউন্ডে ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করেন হোম সেক্রেটারিকে। এ সুপারিশ রাখা না রাখা হোম সেক্রেটারির এখতিয়ার উল্লেখ করে বিচারক তার রুলে বলেছিলেন, আয়সীমা ১৩ হাজারে ফিরে যাওয়াই যৌক্তিক বলে আদালত মনে করে।
এরপর গত বছরের ৫ জুলাই এম এম আবুল জাজিদ ও শাবানা জাবেদ এর পক্ষে হাইকোর্টের জারি করা এই রুলের বিরুদ্ধে হোম অফিসের করা আপিলের শুনানি শেষে কোর্ট অব আপিল শুক্রবার এ রায় ঘোষণা করেন।
অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্রেন্টস (জেসিডব্লিউআই) নতুন এ নিয়মকে অমানবিক আখ্যায়িত করে আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে।
অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ ফ্যামিলি ভিসার ক্ষেত্রে এ নিয়মের পুনর্বিবেচনা দাবি করলেও হোম অফিস এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে। নিয়মটি চালু হওয়ায় প্রায় ১৭৫টি পরিবার নতুন এই নিয়মের কারণে ভোগান্তির শিকার হয় বলে রিপোর্ট প্রকাশ করে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
আয়ের কঠিন শর্ত পূরণ করতে না পারায় এসব পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দেশে বাস করছেন বলে জানায় ওই প্রতিষ্ঠান।
হাউস অব লর্ডসের লিবডেম দলীয় সদস্য ব্যারোনেস হ্যামওয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওই পরিসংখ্যানকে আঁতকে উঠার মতো বলে মন্তব্য করে বলেন, বৈষম্যমূলক নীতির ফলে অনেক পরিবারের সদস্য আজ বিচ্ছিন্ন, যা খুবই অমানবিক।
ফ্যামিলি ভিসার নতুন এই আয়সীমার নিয়ম বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। নতুন নিয়মের কারণে বাংলাদেশি অনেক দম্পতি দিনের পর দিন বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতে থাকে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনে।
বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম এ নিয়ম ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে জানিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যের কারণে বৃহত্তর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানের ইচ্ছা পোষণ করি। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যামিলি ভিসার কড়াকড়ির কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ছেলেমেয়েদের আমরা এখন দেশে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে পারি না। এটি এথনিক কমিউনিটির প্রতি সরকারের একটি বৈষম্যমূলক আচরণ বলেই আমরা মনে করি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১১৯ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪