জাতিসংঘ সদরদফতর, নিউইয়র্ক থেকে: শান্তিরক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এখনও সামনে আছে এবং ভবিষ্যতেও সামনে থাকবে বলে বিশ্ব নেতাদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের ২ নং সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা জানান।
জাতিসংঘ সদর দফতরের কনফারেন্স ভবনের কনফারেন্স হল-৩ এ এই কর্মসূচির আয়োজন করে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, ইউএনডিপির অ্যাডমিন্সট্রেটর মিজ হেলেন ক্লার্ক, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমিরাহ হক ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্তের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সদ্য স্বাধীন লাভ করা বাংলাদেশ তখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সদ্যস্বাধীন একটি জাতির জন্য সহায়তা খুঁজছিল। সেই মুহূর্তে এমন শীর্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থায় অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশি জনগণের জন্য আরেকটি মহান বিজয় হয়ে আসে।
জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সহায়তার জন্য ভারত ও রাশিয়ার মতো দুই বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এই দু’টি দেশ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে এবং জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভেও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
জাতিসংঘের সদস্যপদলাভের এই বর্ষপূর্তিতে শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ সেসব দেশের সরকার ও জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জানান যারা বাংলাদেশের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই, যিনি সেসময় ব্যক্তিগত মানবিক বোধ থেকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সিনেটর কেনেডি কেবল বাংলাদেশি জনগণের ওপর গণহত্যা ও স্বৈরতান্ত্রিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে কণ্ঠ স্বোচ্চারই করেননি, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ পরিদর্শনও করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নিঃস্বার্থভাবে সমর্থন ও স্বাধীনতা পরিবর্তী জাতিসংঘের সদস্যপদলাভে সহায়তার জন্য এশিয়ান ও ন্যাম জোটভুক্ত আফ্রিকান বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যারা প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের সকলকে এ নিশ্চয়তা দিতে চাই যে, জাতিসংঘভুক্ত থেকে আমরা আমাদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করবো।
প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন, ১৯৭৪ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার মাধ্যমেই শীর্ষ সংস্থাটিতে বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। তারপর থেকে ওই ভাষণের আলোকেই জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশেদের সহযোগিতামূলক সম্পৃক্ততা বেড়েছে।
তিনি আরও স্মরণ করেন, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে জাতিসংঘ চার্টারের প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তি, সহনশীলতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক প্রগতি, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও এর অন্যান্য সংগঠনের কার্যক্রমে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও নেতৃত্ব অব্যাহত রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তি, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারভিত্তিক জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাংলাদেশ ও তার জনগণের পাশে থেকেছে।
তিনি স্মরণ করেন, কেবল জাতিসংঘই নয়, সংস্থাটির সদস্যপদ লাভের অনেক আগ থেকেই এর অঙ্গসংস্থা-যেমন ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ডব্লিউএফপি, ফাও, ইউএনএফপিএ, ইউএনআরডব্লিউএ, ইউনেস্কো প্রভৃতি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসে।
১৯৭৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের বাংলাদেশ সফর এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি সংহতি প্রকাশের কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালের পথচলা শুরুর পর গত ৪০ বছরে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সহযোগিতামূলক সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, বিশেষত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি-প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন এবং ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।
জাতিসংঘ ও তার সফল মহাসচিব বান কি-মুনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে এবং বিশ্বসভায় শক্ত অবস্থান লাভ করেছে উল্লেখ করে এ সহযোগিতার জন্য জনগণের পক্ষ থেকে সকলকে একান্ত ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় গত চার দশক ধরেই সামনে থেকেছে বাংলাদেশ। আমরা জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ অধিবেশনে সভাপতিত্বের সুযোগ পেয়েছি। দু’বার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনেও সভাপতিত্ব করেছি। আটবার দায়িত্ব পালন করেছি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকসক) নির্বাহী পরিষদে। এছাড়া, ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ডব্লিউএফপি, ফাও, ইউএন উইমেন ও মানবাধিকার পরিষদসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থার নির্বাহী পরিষদে বেশ কয়েকবার করে দায়িত্বও পালন করেছি আমরা।
প্রধানমন্ত্রী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আমি নিজে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ঐতিহাসিক সম্মেলনে একজন সদস্য হিসেবে যোগদান করি, যোগদান করি ২০০০ সালের সহস্রাব্দ সম্মেলনেও। আমরা শান্তি-প্রতিষ্ঠা কমিশনের উচ্চ-পর্যায়ের একমাত্র বৈঠকেও সভাপতিত্ব করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত দীর্ঘস্থায়ী নীতি-‘বন্ধুত্ব সকলের সঙ্গে, শত্রুতা কারও সঙ্গে নয়’- এর আলোকে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের শান্তি ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এই দাবির পক্ষে প্রমাণ হলো-আমাদের উত্থাপিত ‘শান্তির সংস্কৃতি ও বিশ্বের শিশুদের ওপর অ-সহিংসতার দশক, ২০০১-২০১০’ প্রস্তাবনা জাতিসংঘে গৃহীত হওয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন’ প্রস্তাবনায় সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জনগণের ক্ষমতায়নকে জোরালো সমর্থন দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শান্তি-কেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে। চারটি মহাদেশে ৫৪ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের এক লাখ ২৮ হাজার ‘নীল হেলমেট’ধারী কাজ করছেন। আজকের এই দিনে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মদান করা আমাদের সেই ১১৯ বীর সন্তানকে স্মরণ করছি।
এমডিজি ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় অর্জনে এ দেশকে ‘রোল মডেল’ বলে স্বীকৃতি দেওয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
সদস্যপদলাভের ৪০ বছর পূর্তিতে জাতিসংঘের সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অর্জনের জন্য গর্ববোধও প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
ভাষণ শেষে ভবিষ্যতে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পৃক্ততার রোডম্যাপ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। রোডম্যাপটি হলো-
*আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতেও বাংলাদেশ তার অঙ্গীকারের ওপর অবিচল থাকবে।
*বিপদগ্রস্ত বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় সর্বোচ্চ ভিত্তিতে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী দেশগুলোর কাতারে সামনে থাকবে।
*যুদ্ধ, সংঘাত ও সশস্ত্র সহিংসতার কার্যকর প্রতিরোধে জাতিসংঘের ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ অন্য সদস্যগুলোর সঙ্গে কাজ করবে।
*শান্তি-প্রতিষ্ঠা কমিশনে বাংলাদেশ তার জাতি-প্রতিষ্ঠার নিজস্ব অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে অবদান রাখবে।
*পারমাণবিক, সামুদ্রিক, মহাকাশ ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ এজেন্ডা বাস্তবায়নে দৃঢ়ভাবে সামনে থাকবে বাংলাদেশ।
*সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে, মানুষে মানুষে লড়াইয়ের বিরুদ্ধে এবং মাদক ও বন্যপ্রাণী পাচারের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অবদান রাখবে।
*বাংলাদেশ শান্তির সংস্কৃতিকে সমর্থন করে যাবে এবং সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ও কাউকে পিছিয়ে না রাখতে জনগণের ক্ষমতায়নকে অগ্রসরের পথ দেখিয়ে যাবে।
*মানবতাবিরোধী অপরাধ, যৌন সহিংসতা ও গণহত্যা থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার সংস্কৃতি ভাঙতে বাংলাদেশ অপরাধীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পদক্ষেপকে সমর্থন করে যাবে।
*বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষার নীতি নির্ধারণে বাংলাদেশ গঠনমূলক অবদান রেখে যাবে।
*জাতীয় মানবাধিকার, সুশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করবে বাংলাদেশ।
*নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ মেয়ে শিশু ও নারীর ক্ষমতায়নকে সমর্থন করে যাবে।
*শিশুদের অধিকার বিষয়ক কার্যক্রমে বাংলাদেশের সহযোগিতা আরও বাড়তে থাকবে, বিশেষত অটিজমের মতো ব্যাধি আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে।
*এমডিজি অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে বাংলাদেশ ২০১৫ পরবর্তী যুগে দৃঢ়চিত্তে প্রবেশের মনস্থির করেছে এবং এ লক্ষ্যে অবিচল থাকবে।
* এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ তার কার্যক্রমকে দ্রুততর করবে এবং ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন কাঠামোর আলোকে পরিমেয় ও অর্জনীয় লক্ষ্য অর্জনে মতৈক্য সৃষ্টিতে কাজ করবে।
*বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থেই জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লভ্যাংশ প্রদানের দাবিতে জোরালো বক্তব্য রেখে যাবে।
শান্তি ও সংঘাত বন্ধে বিশ্ব নেতাদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার ডাক দিয়ে ভাষণ শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ সময়: ০২৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪