ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

লাশের রাজনীতি ও দু’টি কথা

নিনি ওয়াহেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪
লাশের রাজনীতি ও দু’টি কথা

সপ্তাহ দু’তিন আগে দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত তিনটি লেখা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লেখা তিনটি পিয়াস করিমকে নিয়ে।

সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। তাকে নিয়ে লাশের রাজনীতি করা হয়েছে বলে দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ, জ্ঞানী-গুণীজনদের অনেকে নানান কথা লিখেছেন, বলেছেন, নানান মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়েছেন। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে; এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। শহীদ মিনারে পিয়াস করিমের লাশ নেওয়ার অনুমতি না দেওয়াকে কেন্দ্র করেই এসব লেখালেখি ও সমালোচনা। যে তিনটি লেখার প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে তা নিয়েই আমার আজকের বক্তব্য।

এর দু’টি লিখেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না এবং একটি লিখেছেন সোহরাব হাসান। তিনটি লেখা পিয়াস করিমের লাশ শহীদ মিনারে রাখতে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে।

কারো মৃত্যুতে কেউ শোক প্রকাশ করতে পারেন, কেউ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, আবার কেউ না-ও পারেন। অবশ্য এ সকল কিছুই একজন মানুষের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত। সেখানে যেমন জোর খাটানো যায় না শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, ঠিক তেমনিভাবে বাধা দেওয়াও যায় না। এমনটি ভাবাই স্বাভাবিক এবং হওয়া উচিতও তাই। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। কিন্তু কি কারণে তা ঘটেছে তা খতিয়ে দেখতে গেলে প্রথমে বলতে হয় যে তার লাশ শহীদমিনারে রাখার প্রস্তাবের মধ্য দিয়েই কী লাশের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটানো হয়নি? এমন ভাবনা কী যুক্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়? অথবা সঠিক নয় বলে বিবেচিত হতে পারে?

মাহমুদুর রহমান মান্না নিজেই লিখেছেন, বাংলাদেশের হাজারটা মানুষ যেভাবে পিয়াস করিমকে চেনে আমিও সেভাবেই চিনেছিলাম তাকে। টেলিভিশন টকশোতে দেখা হয়েছিল অর্থাৎ তারপর পরিচয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে টকশোতে কথা বলা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হবার জন্যই কি তার লাশ শহীদমিনারে নেয়ার প্রয়োজন ছিল? বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকের লাশই শহীদমিনারে কেন নেয়া হবে না- এ প্রশ্ন তো যে কেউ করতে পারেন। শুধু তাই নয় ১৬ কোটি মানুষের লাশই শহীদমিনারে রাখার প্রস্তাব উঠতে পারে কারণ শহীদ মিনার কারো নয়, সকলের। অথচ এই দু’জনই মনে করেন, শহীদমিনার বাঙালি জাতির অখণ্ড স্মারক এবং শহীদমিনার কেবল ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মারক নয়, জাতীয় ঐক্য ও চেতনারও প্রতীক।

এমন একটি মর্যাদাসম্পন্ন, পবিত্র ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বলে চিহ্নিত কোনো স্থানে কোন মাপকাঠিতে কাদের লাশ রাখা যাবে তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। জাতির এই অখণ্ড স্মারকে জাতির জন্য কী অবিস্মরণীয় অবদান, ভূমিকা ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য যে কারো লাশ রেখে শ্রদ্ধা জানাতে হবে তার একটি চুলচেরা বিশ্লেষণ ও মাপকাঠি নির্ধারণ করার তাগিদ অনুভব করা বিশেষ প্রয়োজন।

মাহমুদুর রহমান মান্না আরও লিখেছেন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে পড়লেও তিনি পিয়াস করিমকে চিনতেন না। কারণ তিনি সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি বা সে রকম কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। অর্থাৎ ছাত্রদের সমস্যা, সংকট বা কোনো ইস্যুতে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। সেই সঙ্গে রাজনীতি বা কোনো সংগ্রাম আন্দোলন কোনো কিছুতেই তার কোনো সক্রিয়তা ছিল না। কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাম্প্রতিককালের টক শো’র একজন আলোচক হওয়ার সুবাদেই তার লাশ শহীদ মিনারে নেওয়ার প্রশ্ন কী উঠতে পারে? এমন প্রশ্ন উঠল কেন? এটা কী সত্যি তার পরিবারের ইচ্ছা ছিল না কী অতি সম্প্রতি তিনি যে, রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, সেই রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা প্রণোদিত ছিল? সোজা-সাপটা সমীকরণে বিষয়টি কী দাঁড়ায়?

মাহমুদুর রহমান আরও বলেছেন, পিয়াস করিমের সাথে কথা বলে তার ভাল লেগেছে। কারণ তিনি অবাধ ও মুক্ত মত প্রকাশের এবং মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। মান্না আরও লিখেছেন, তাকে তাঁর দলের সদস্য পর্যন্ত করেছিলেন এবং দলের পূর্ণ দায়িত্বও তাকে হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিয়াস করিম হঠাৎ করে বিএনপি’তে যোগ দেয়ায় তার সে আশা পূরণ হয়নি।

মুক্ত চিন্তা-চেতনার একজন মানুষ কেমন করে হঠাৎ করে দল বদল করেন, যেখানে তিনি ইতিমধ্যে একটি দলে যোগ দিয়ে ফেলেছেন। তার মতাদর্শ বা আদর্শিক জায়গাটা কী প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? অবশ্য মাহমুদুর রহমান ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, গণজাগরণ মঞ্চের সাথে তার ভুল বোঝাবুঝি এবং নিরাপত্তারহীনতার কারণে তিনি এ-কাজ করেছেন। মাহমুদুর রহমানের মত একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছে এমন ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত নয়।

তাহলে বলতে হয় গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ও গণজাগরণমঞ্চের কর্মীদের তো টেলিফোনে ও ফেসবুকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাই বলে তারা দল পরিবর্তন করেছেন বা আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অন্য কোনো দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন কলে আমাদের জানা নেই।

তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে এমন কেউ কি আছেন যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারবেন? তার কথা-ই ধ্রুব সত্য হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল বৈকি। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য তা হয়নি। হয়নি যে, এটি কি সত্যি নয়? ১৯৭১ সালের সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাসের বর্বরতম নৃশংস গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের রায় প্রকাশের পরে বিএনপির মত একটি রাজনৈতিক দল ও দলের নেতৃবৃন্দের কঠিন নীরবতা কী সেই বিরোধিতার মনমানসিকতাকেই প্রমাণ করে না? শুধু নিরবতাই নয় যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী গণহত্যার দায়ে দায়ী জামায়াত শিবিরের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে সফল করতে নিজেদের কর্মসূচির পরিবর্তন কী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করার পর্যায়ে পড়ে না।

এবার আসি সোহরাব হাসানের লেখায়, তাঁর কিছু বক্তব্যের সাথে সহমত প্রকাশ করে বলতে হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পিয়াস করিমের লাশ শহীদমিনারের নেয়ার অনুমতি না দিয়ে বিরোধিতাকারীদের সমাবেশ করার অনুমতি হয়তো না দিলেও পারতেন সৌজন্যের খাতিরে। কিন্তু তারা তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে লেখা ব্যানারের ভাষা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু যে বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ হয় তা হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকেই এই ট্রাইব্যুনাল ও বিচারকার্য সম্পর্কে কতগুলো টকশো হয়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশনে এবং যেখানে পিয়াস করিম উপস্থিত ছিলেন। তা যদি সোহরাব হাসান ভিডিও থেকে দেখে নেন তাহলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, তার বক্তব্য ট্রাইব্যুনালকে শক্তিশালী করা, দক্ষ প্রসিকিউটর নিয়োগ করা বা সুষ্ঠু বিচারকার্য পরিচালনার জন্য করা হয়নি। তা সম্পূর্ণই ছিল দেশের জামায়াত ও বিএনপির বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। ফলে সোহরাব হাসান, রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত বা দ্বিমত প্রকাশের কারণে কারো লাশ শহীদ মিনারে নেয়া যাবে না বলে যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তা কোনভাবেই সঠিক নয়। ট্রাইব্যুনালের দুর্বলতা ঘোচানোর জন্য, ট্রাইব্যুনালের অবস্থানকে শক্ত-পোক্ত করা ও স্বচ্ছ বিচারকাজের জন্য অনেকেই কথা বলেছেন কিন্তু পিয়াস করিমের বক্তব্যের পার্থক্যটা যদি আমরা গণতান্ত্রিক ও সভ্য রাষ্ট্রের অজুহাতে এড়িয়ে যাই তাহলে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হবে। সোহরাব হাসান ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি বক্তব্য তুলে ধরেছেন:, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু তোমাকে তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত আছি’। ‘ কিন্তু গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীদের মত ৭১ এর গণহত্যার হোতাদের এবং তাদের সমর্থনকারী, আশ্রয় প্রশ্রয়দানকারীদের ক্ষেত্রে কী তা প্রযোজ্য হতে পারে? আর তা কী আমরা হতে দিতে পারি?

পরিশেষে বলতে হয়, যারা পিয়াস করিমের লাশ শহীদমিনারে নেওয়ার অনুমতি না-দেওয়ার তীব্র নিন্দা ও সমালোচনায় মুখর এবং একে রাজনীতিকরণের জন্য সরকারকে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করছেন তারা কিন্তু তার লাশ শহীদমিনারে নেওয়ার প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে যারা লাশের রাজনীতি করার সূত্রপাত ঘটিয়েছে তাদের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। নিন্দা তো দূরের কথা। এটি দুঃখজনক।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪


** কেমন আছেন দেশ ও প্রবাসের প্রবীণেরা
** ভালবাসার শব্দহীন অনুভূতি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ