ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

হিমঠাণ্ডার নিউইয়র্কে দেখা গুটিকয় বাংলাদেশির কথা

দিদারুল ইসলাম মানিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
হিমঠাণ্ডার নিউইয়র্কে দেখা গুটিকয় বাংলাদেশির কথা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কনকনে শীত। সাথে দমকা বাতাসও।

রাস্তার দু’পাশে তুষার জমে বরফ হয়ে আছে। কোথাও কোথাও বরফ গলে গিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে করে তুলেছে কংক্রিটের সড়ক। ওয়াকওয়ের দু’পাশে বরফ জমে থাকায় পথচারীদের হাঁটতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। নিউইয়র্কে গত ১৫০ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তুষারপাত হয়ে গেলো ক’দিন আগে। সেই সময়টিতেই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি কয়েক জনের জীবনচিত্র চোখে পড়লো। যা ভীষণ মন খারাপ করে দিয়েছে, একই সঙ্গে উদ্বিগ্নও করে তুলেছে। আর সে কারণেই এই লিখতে বসা।
 
জনজীবন তখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধ্যুসিত জ্যাকসন হাইটস এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও জীবীকার সন্ধানে নেমে পড়েছে কয়েকজন। কনকনে শীতে ফুটপাথে জমে থাকা বরফের ফাঁক ফোকরে পসরা সাজিয়ে বসেছেন কয়েকজন।   তবে কোন ক্রেতা নেই।

সাবওয়ে থেকে ৭৩ স্ট্রিটের দিকে মোড় নিতেই ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধের সাথে দেখা। মুখভর্তি দাড়ি। হাতে অনেকগুলো ফ্লায়ার। রাস্তা দিয়ে যে-ই যাচ্ছে একটি করে হাতে গুজে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

দেখলাম একটি ফার্মেসির ফ্লায়ার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভাল আছি’।

নাম মঞ্জুরুল ইসলাম। জানালেন, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় বাড়ি। তিন ছেলে এক মেয়ে। এরমধ্যে বড় ছেলে প্রতিবন্ধী। বাকি দু’জন ঢাকায় ছোটখাটো চাকুরী করেন। জায়গা-জমি তেমন নেই। দেশে ৪০ বছরের মতো গতরে খেটেছেন। এখানে  মেয়ে আর মেয়ের স্বামীর সাথে থাকেন। মেয়ের বদৌলতে বছরখানেক আগে আমেরিকায় এসেছেন।

যাইহোক, এই আমেরিকায় মেয়ে জামাইতো শ্বশুরকে বসে বসে খেতে দিতে পারেন না! সে কারণে তাকে নিজেকেই নেমে পড়তে হয়েছে কাজে।

এতো ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্লায়ার বিলি করছেন, না করে পারা যেতো না? এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন- ঠাণ্ডা বলে তো জীবন থেমে থাকবেনা। কাজ না করলে তো টাকা পাবোনা। অসহনীয় ঠাণ্ডা পড়ার কারণে তিন দিন কাজ করতে পারিনি। আজ শীত সামান্য ধরে আসায় নেমে পড়েছি।

মঞ্জুরুল জানালেন, এই কাজে তার ঘণ্টায় ৫ ডলার দরে দিনে চারঘণ্টা কাজের হিসাবে আয় ২০ ডলার। এটা দিয়ে কী হয়? সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘কিছু করার নাই। বললেই তো আর তারা আওয়র বাড়িয়ে দেবেনা। এখানে চাইলেই একটা কাজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাছাড়া, বয়সের কারণে এখনতো আর ভারী কাজ করতে পারবোনা। ’

এরপর বলেন, চাকরি থাকলে দিয়েন। ’

৭৩ স্ট্রিটেই দেখা মিলল আরেকজন বাংলাদেশির। একটা দোকানের বাইরের অংশে সাটারের সঙ্গে ঝুলিয়ে তিনি মেয়েদের জামা-কাপড় বিক্রি করেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তিনিও জবুথবু। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো তার সাথে।

পরিচয় জানার পর পত্রিকায় যেন ছবি না ছাপানো হয় সেই শর্তে সংগ্রামী জীবনের গল্প করলেন ফয়সাল নামের এই যুবক। জানালেন বছর দশেক আগে আমেরিকায় এসেছেন। দেশে ভালই ছিলেন। ঢাকায় ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সব বিক্রি করে আমেরিকায় পাড়ি জমান। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন পরিবর্তন দেখতে পাননি। ১০ বছর আগে যেখানে ছিলেন এখনো সেখানেই রয়ে গেছেন।

জানালেন, নিউইয়র্কে এসে টানা আট বছর অড জব করার পর দু’বছর ধরে এ ব্যবসা শুরু করছেন। শুরুতে মোটামুটি ভালই চলছিলো। কিন্তু এখন কোনওরকম টেনেটুনে সংসার চলে। কয়েক মাস ধরে ব্যবসাও বেশ মন্দা। মাস শেষে যা আয় হয় তা দিয়ে বাসাভাড়ার টাকা যোগাড় করা কষ্ট।

ফয়সাল বলেন, ‘জানিনা এভাবে কতদিন টেনে নিয়ে যাব। মাঝেমাঝে নিজের ওপর বেশ রাগ হয়। কখনো কখনো ভাবি আবার অড জবে ফিরবো। যখন পূর্বের অভিজ্ঞতা সামনে চলে আসে তখন আর ভালো লাগেনা। ’

ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার এই যুবক আরো জানান, বাংলাদেশি অনেক রেস্টুরেন্ট গ্রোসারি থেকে কাজের অফার পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কর্মচারীদের ঠকান বলেই অভিযোগ তার।

ফয়সাল বলেন, বলতে গেলে কেউই নিউইয়র্কে যে মিনিমামওয়েজ সেটা দেয়না। রেস্টুরেন্টগুলোতে তো ২ থেকে ৩ ডলার ঘন্টায় দেয়া হয়। এ বৈষম্যের ব্যাপারে কথা বললে মালিকরা বলেন, তোমরা যা টিপস পাও সেটাতো অনেক বেশি। ঘন্টায় যা দেই সেটাই বেশি।
 
রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের বাস্তব অবস্থা বুঝতে ৭৩ স্ট্রিটের ৩৭ এভিন্যুতে একটি বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে গেলাম। যিনি খাবারের অর্ডার নিলেন তার নাম আশরাফ (ছদ্মনাম)। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানালেন, তিনি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র-রাজনীতিও করতেন। ১/১১ এর পর তিনি দেশ ছাড়েন। অনেকটা পরিবারের চাপে। ভাগ্যান্বেষণে প্রথমে যান লন্ডনে। সেখানে দু’বছর থাকার পর চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। এসেই কোন উপায় না পেয়ে রেস্টুরেন্টে কাজে যোগ দেন। ঘন্টায় ৫ ডলার মজুরিতে। সাথে কিছু টিপসও পান। এরপর জানালেন, লিগ্যাল স্ট্যাটাস বজায় রাখতে একটা কলেজে কোনরকম এডমিশন নেন। সপ্তাহে ছ’দিন ১০ ঘন্টা করে কাজ করেন। দুপুর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। এরপর রয়েছে কাস্টমার ও মালিকের দুর্ব্যবহার।

কাজে যতক্ষণ থাকি চুপচাপ থাকি। কারো সাথে তেমন কথা বলিনা। বাকি সময় বাসায় ঘুমিয়ে কাটাই, বলেন এই সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী।

কথা বলতে বলতে এক সময় তার চোখ পানিতে ভরে আসে। চোখ দুটো অনেকটা খোলসের ভেতর চলে গেছে। অশ্রুগড়িয়ে পড়তে চাইলেও তা সংবরণ করার চেষ্টা করছেন। একটা হাত বেরকরে দেখালেন যে একদিন সালাদ কাটতে গিয়ে আঙুলই কেটে ফেলছিলেন। অনেকগুলো সেলাই দিতে হয়েছিলো হাতে। পনেরো দিনের মতো কাজ করতে পারেননি।

এভাবে কতদিন কাটাবেন?, জানতে চাইলে আশরাফ বলেন, কখনো ভাবিনি জীবনে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। এখান থেকে সরতেও পারছিনা। কোন পথ দেখছিনা দেশে চলে যাওয়া ছাড়া। বাবার অনেক টাকা খরচ করে এখানে এসেছি। খালি হাতে ফিরে গেলে কী জবাব দিবো। সাতপাঁচ ভেবে আর কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। জানিনা ভাগ্যে কী আছে।

শুধু আশরাফ, ফয়সাল আর মঞ্জুরুলই নয় নিউইয়র্কে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার এরকম হাজারো মানুষ, হাজারো বাংলাদেশি। অধিকাংশের গল্পটিই অনেকটা একই রকম। উচ্চ জীবনের স্বপ্ন নিয়ে হাজারো বাংলাদেশি আমেরিকায় আসলেও সে স্বপ্ন রঙিন হয়ে ধরা দেয়না। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে জীবন। বীতশ্রদ্ধ জীবনে হাহাকার থাকলেও নতুন স্বপ্নের, নতুন ভোরের দিন গুনতে থাকেন তারা। কেউ কেউ পেয়েও যান সেই সোনালী দিন। তাদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাদের গল্প আরেকদিন শোনানোর প্রত্যাশা থাকলো...

লেখক: সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ই-মেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ