ওয়াশিংটন: ‘লেগে থাকো, নির্দেশনা মানো আর আন্তরিক হও’- এ তিন মূলমন্ত্রে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের পথে হাঁটিয়ে নিচ্ছে পিপলএনটেক। যুক্তরাষ্ট্রের এই বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে এর আগেও বহুবার লিখেছি।
নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই গত ২৯ অক্টোবর হাজির হই পিপলএনটেকের ভার্জিনিয়া কার্যালয়ে।
ডিস্ট্রিক্ট কলাম্বিয়ার এই কাউন্টিতে বাংলাদেশিদের বসবাস রয়েছে। তবে পিপলএনটেকের আবুবকর হানিপ তার কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছেন শহরের প্রাণকেন্দ্রে।
স্প্রিং হিল রোডের ওপর বৃহৎ কর্পোরেট কার্যালয়। শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, সার্ভার রুম, মিটিং রুম, ডিসকাসন রুমসহ নানা সুবিধাদিতে ভরা এ কেন্দ্রে একসঙ্গে দুই শতাধিক প্রশিক্ষণার্থীক আইটি শেখাতে পারছে পিপলএনটেক।
সেখানেই কথা হচ্ছিলো প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতদেরসহ এখান থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে এখন তাদের ভাগ্য গড়েছেন সিক্স ডিজিটের স্বপ্ন পূরণে এমন কয়েকজনের সঙ্গে।
তারাই জানালেন, লেগে থাকো, নির্দেশনা মেনে এগোও আর আন্তরিক হও- এ তিন মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েই তারা আজ জীবনের নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন। এগোচ্ছেন উন্নত জীবনের পথে ধরে।
সাইদ হক তামিম নামের যুবকের কথাই ধরুন না। বলছিলেন, ‘আমি সাবওয়েতে কাজ করতাম, ঘণ্টায় ৫/৬ ডলার করে পেতাম। তাতে আমার দিনে আয় ছিলো ৪০ থেকে ৫০ ডলার। সপ্তাহে ৩৫০ ডলার। তাতে মাসে আসতো ১ হাজার ৪০০ ডলার। বছরে যা হতো মাত্র ১৬ হাজার ৮০০ ডলার। এখন আমি বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের চাকরি করি। আসলে জীবনটাতে ১০০০ শতাংশ উন্নতি এসেছে’।
এ উন্নয়নের পেছনে নিজের চেষ্টা ছিলো বটে, কিন্তু তার কোনো ক্রেডিটই নিতে চান না তামীম। তিনি বলেন, ‘আমার ভূমিকা এটুকুই যে, বন্ধুর মাধ্যমে জেনে পিপলএনটেকে এসে ভর্তি হয়েছিলাম। আর পরের পুরোটাই পিপলএনটেকের। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে হানিপ স্যারের (ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ)’।
এই হানিপকে আগেও বাংলানিউজের পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। যারা মিস করে গেছেন, তারা পড়ে নিন... ‘মে আই হানিপ ইউ!’
তামিম জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সারির ফরচুন ওয়ান হানড্রেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আইটি বিভাগে এখন তিনি কাজ করেন। যে তামিম আইটির কিছুই জানতেন না, পিপলএনটেকের একটি প্রশিক্ষণে তার এমন আইটি নলেজ হয়েছে যে, অল্প কিছু দিনেই তিনি সিনিয়র পজিশন পেয়ে গেছেন।
পাশেই বসেছিলেন আবুবকর হানিপ। বিনয়ী, আর মানুষকে সহযোগিতা করতে পারাতেই যার বড় শান্তি। বললেন, ‘আমি মনে করি, তামিমের নিজেরও যোগ্যতা রয়েছে, তাই সে পেরেছে। আমরা কেবল তার ভেতরের প্রতিভাটিকে শান করে দিয়েছি। আমরা তাকে পথ দেখিয়ে দিতে পেরেছি। আমি চাই না, বাংলাদেশিরা এখানে এসে সাবওয়ে, সেভেন-ইলেভেন কিংবা ম্যাকডোনাল্ডসে তাদের জীবনের গণ্ডি বেঁধে ফেলুক’।
‘আমি একটি কৌশল জেনেছি, তা দিয়ে আমার নিজের জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছি। আর সে জ্ঞান কেবল নিজের মধ্যে রাখিনি। ছড়িয়ে দিয়েছি হাজার হাজার মানুষের মধ্যে, আর দিয়েই চলেছি। আমার একটাই লক্ষ্য, কোনো বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে এসে অডজব করবে না’।
‘আর ওই যে সিনিয়র হয়ে যাওয়ার কথা বললেন, আসলে পিপলএনটেকের প্রশিক্ষণটিই এমন যে, যে কাউকে সিনিয়রের যোগ্য করেই তৈরি করে। ফলে মূলত কাউকে আর ফ্রেশার হয়ে ঢুকতে হয় না’।
বাংলানিউজকে অন্য এক সাক্ষাৎকারে হানিপ সে কথাও আগে বলেছিলেন, ফ্রেশার ও অডজব শব্দ দু’টিই তিনি রাখতে চান না।
ভার্জিনিয়া অফিসের সেদিনের আড্ডায় আরও ছিলেন জিতেন্দ্র কে মাথুর জয়। ভারতীয় বংশোদ্ভুত এই আমেরিকান তার স্বপ্ন গড়েছেন পিপলএনটেকের হাত ধরে।
জয় এখন বড় একটি প্রতিষ্ঠানে বড় চাকরি করেন অনেক বড় বেতনে। তারও সিক্স ডিজিটেরই চাকরি, তবে শুরুর অংকটি আর ১ নয় বরং ২। অর্থাৎ ২ লাখ ডলারের বেশি।
পিপলএনটেক কেবল মানুষকে কাজ পাইয়ে দেওয়াই নয়, তাদের কাজে টিকে থাকার এবং ক্রমে উন্নতি করে যাওয়ার পথটিও বাতলে দেয়। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখেছি, কেউ কাজ পেলো হয়তো, সপ্তাহ খানেকের মধ্য তা হারিয়েও ফেললো। কিন্তু পিপলএনটেকের গ্রাজুয়েটদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না।
জয়ের একটি দারুণ দিক সম্পর্কে বলছিলেন আবুবকর হানিপ। তিনি জানান, ‘এই যুবক তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালো কাজ করছেন। পরে তিনি নিজেই এগিয়ে এসেছেন, তার জ্ঞান অন্যদেরও দিতে চান। সে কারণে যখনই সুযোগ পান পিপলএনটেকে এসে বিনামূল্যে কনসালট্যান্সি করেন। যা একটি অসাধারণ কাজ। অন্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার যে সহযোগিতার মনোভাব আমি দেখছি, তাতে স্রেফ মুগ্ধ’।
আলোচনা হচ্ছিলো হিডেন ট্রিকসটা নিয়ে। জয়ই বলছিলেন, ‘আমরা আসলে একটা কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলি। এরপর শেখাই। আর সেটাই কৌশল। এখানে আসলে সংজ্ঞা শেখানো হয় না, কাজটা শেখানো হয়। আসলে এটি হচ্ছে 'হানিপ মডেল'। কেবল সফটওয়্যার, কেবল মডেল আর কেবল প্রশিক্ষণ নয়, সবকিছুর সমন্বয়ে একটি ভিন্নধর্মী মডেল’।
‘এখানে কেউ ভর্তি হন ছাত্র হয়ে, বের হন শিক্ষক হয়ে, এটাই মডেল’- বললেন হানিপ।
কেউ যখন একবার পিপলএনটেকের প্রশিক্ষণার্থী তখন সারা জীবনের জন্য তিনি এর সুবিধাভোগী কিংবা এর কর্মী।
যার উদাহরণ দিতে গিয়ে হানিপ জানালেন, ওই দিন তামিম তার সেন্টারে এসেছেন তার কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে সামান্য কিছু বিষয়ে জটিলতায় পড়েছেন তার সমাধান করে নিতে। টেক্সাস থেকে ভার্জিনিয়ায় ছুটে এসেছেন তিনি। আর ডিসিতেই কাজ করেন জয়। তিনিও এসেছেন স্রেফ তামিমকে সহযোগিতা করতে।
সুতরাং, পিপলএনটেক স্রেফ কোনো ব্যবসা বা প্রশিক্ষণকেন্দ্র নয়, একটি সহায়তাকেন্দ্রও বটে।
প্রতিটি কোর্স চার মাসের, যার জন্য প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে দিতে হয় ৪ হাজার ডলার করে। তবে একবার পে করে যতোদিনে না পুরোপুরি তৈরি হন, ততোদিনই কোনো প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিতে পারেন এই সেন্টারে।
রিভানা সরফুদ্দীন এ অফিসেই কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই বাংলাদেশি মেয়েটিও যেনো তার স্বপ্নের পথ খুঁজে পেয়েছেন পিপলএনটেকে। যদিও প্রশাসনিক বিভাগেই তার কাজ, তবে নিজেও শিখছেন। এবং জানেন, লেখাপড়া শেষ হলেই তাকে আর কোনো ফ্রেশার কিংবা ছোট কাজে যোগ দিতে হবে না।
লায়লা জেসমিনও পিপলএনটেকের কর্মী। তিনি কাজ করেন জব প্লেসমেন্টের। সারাক্ষণ খোঁজ-খবর রাখেন, কোথায় কাজ আছে, কোথায় ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেসব স্থানে পিপলএনটেকের গ্রাজুয়েটদের পাঠান। আর তারা কাজ পেয়ে যান।
লায়লা জানালেন, প্রশিক্ষণের বাইরে তারা জব প্লেসমেন্ট, কাউন্সিলিং, প্রজেক্ট সম্পর্কে ধারণা, ডাক পাইয়ে দেওয়া, সাক্ষাৎকার দেওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। ফলে কাজ পেতে কষ্ট হয় না, কিংবা সময়ও লাগে না।
পিপলএনটেকের এখন ১০ জনের টিচার্সপুল রয়েছে। ডিসি'র ভার্জিনয়া ছাড়াও নিউইয়র্কের অ্যাস্টোরিয়া ও ব্রকলিনে, কানাডার টরন্টো এবং বাংলাদেশের ঢাকায় তাদের সেন্টার রয়েছে।
এসব সেন্টার থেকে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী তাদের স্বপ্ন পূরণ করছেন। আর পিপলএনটেক কিংবা এর প্রতিষ্ঠাতা আবুবকর হানিপ হয়ে উঠছেন সহযোগিতার আরেক নাম।
সেন্টারের ক্লাসরুমগুলোতে ঢুকে দেখা গেলো, বাংলাদেশি ছাড়াও খোদ আমেরিকান, স্প্যানিশ, মেক্সিকান ও এশীয় শিক্ষার্থীরা রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৬
এমএমকে/এএসআর