প্রাণের কবি শহীদ কাদরী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। গত ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস্থ জুইশ সেন্টারেও তিনি ছিলেন।
যারা সেদিন এসেছিলেন তাদের কাছে মনে হয়েছে স্বপ্নের ভেতর কিংবা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। অনেকের জীবনেই এমন দৃশ্যপট কখনো চোখে পড়েনি। এমন একটি অসাধারন পরিবেশে আসাও ছিলো অভূতপূর্ব। একজন কবিকে ভালোবেসে এতো বিরাট, ব্যাপক এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল আয়োজন হতে পারে কেউ হয়তো কল্পনাও করেননি। তবে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান এবং আধুনিকতম কবি হিসেবে কবি শহীদ কাদরী এই ভালোবাসার দাবিদার বলে কারোই দ্বিমত নেই।
মাত্র আড়াই ঘন্টার এই অসাধারণ আয়োজন শেষে বিদায় নেয়ার সময় কনসাল জেনারেল শামীম আহসান অন্যতম আয়োজক আকবর হায়দার কিরনকে বললেন, 'আপনারা কি করে পারলেন এই অসামান্য অনুষ্ঠান আয়োজন করতে, যারা আসেননি তারা জানেননা কি মিস করলেন'।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার অত্যন্ত ব্যয়বহুল, বর্ণময় এবং জমজমাট আয়োজনের পরিকল্পনা, গ্রন্থনা এবং নির্দেশনায় ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী ও আবৃত্তিকার মিথুন আহমেদ।
বেশ কয়েক সপ্তাহ নিয়মিত কাজকর্ম ছেড়ে, রাতের পর রাত জেগে এই অনুষ্ঠানের জন্যে কাজ করেছেন। তার এই অনন্য শৈল্পিক আয়োজনকে বাস্তবে রুপ দিতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন কবি শহীদ কাদরীর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী, কবির বিশেষ প্রীতিভাজন, বিশিষ্ট সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরন।
ঢাকা এবং নিউইয়র্কের একদল কৃতি শিল্পী একযোগে দিনের পর দিন কাজ করেছেন বিভিন্ন দৃশ্যের পরিকল্পনা নিয়ে। শিল্পী নজিব তারেক কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে অসাধারন সব শিল্পকর্ম তৈরি করেন।
কবির বিভিন্ন কবিতা দিয়ে প্রস্তুত হয় ছাদ থেকে ঝোলানোর ১৫টি শৈল্পিক ব্যানার। অনুষ্ঠানের শুরুতে ব্যবহৃত 'প্রণতি' পর্বের জন্যে নির্মিত দেয়াল জোড়া বিশাল ব্যাকড্রপ ছিলো বিস্ময়কর। 'প্রতিধ্বনি' পর্বের ব্যাকড্রপ ছিলো আরও বড় সাইজের। নিউইয়র্কে বিশেষ মুদ্রন ও প্রচারে সহায়তা প্রদান করেন নোঙরের পক্ষে শিল্পী জাহেদ শরীফ।
সবাইকে স্বাগত জানিয়ে মিথুন আহমেদ বলেন, শহীদ কাদরী , নাগরিক জনারণ্যের চির-তরুন কবি সমসাময়িক জগতের এক সচেতন ও সযত্ন পর্যবেক্ষক এবং তীক্ষ্ণ বিশ্লেষক। জগত ও জীবনবীক্ষার যে নির্যাস তিনি গ্রহণ করেছিলেন , নিঃশেষে তা ঢেলে দিয়েছেন কবিতায় এবং পারিপার্শ্বিকতায়। কবি শহীদ কাদরীর কবিতা ও জীবনবীক্ষা আমাদের সংগ্রহে থাকা এক অমুল্য সম্পদ। আমাদের অনুভুতি এবং কবির কর্ম ও জীবন নিয়ে আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠান 'প্রণতি ও প্রতিধ্বনি'। প্রয়ানহীন কবি শহীদ কাদরীর ও তাঁর ভালোলাগা-মন্দলাগা, তাঁর স্মৃতি ও শ্রুতি আমাদের এই উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য।
মিথুন আহমেদ আরও বলেন, একজন কবি যেমন যাপন করেন তাঁর নিজস্ব অক্ষবিন্দুতে, ঠিক তেমনি একটি নির্দিষ্ট ভূমণ্ডলে বসবাস করেও ব্রহ্মাণ্ডের আশপাশটাতেও নিত্য বিচরণ- পরিব্রাজন তাঁর ।
অনুষ্ঠানে স্মৃতির স্মারক পাঠ করেন মুহম্মদ ফজলুর রহমান ও মিনহাজ আহমেদ। কবির উদ্দেশ্যে এলিজি পাঠ করেন আকবর হায়দার কিরন, গোপন সাহা, সেমন্তী ওয়াহেদ ও মাহতাব সোহেল।
সমবেত সবাইকে আবেগে আপ্লূত করেন আকবর হায়দার কিরন। তিনি বলেন, কবি শহীদ কাদরী একজন বিশ্ব সভার কবি হিসেবে জন্মেছিলেন। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান এই কবিকে কেউ ড্রইংরুম কিংবা বেসমেন্টে সীমিত করে রাখতে পারবেননা।
কিরন বলেন, আমাদের প্রানপ্রিয় শহীদ ভাইয়ের আত্মা এই মুহূর্তে আশেপাশেই রয়েছে।
মিথুন আহমেদ ও সাবিনা হাই উরবির উপস্থাপনায় 'প্রণতি ও প্রতিধনি'র শুরুতেই সম্প্রতি অকাল প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিলের জন্যে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে কবির প্রথম স্ত্রী, দীর্ঘদিন জার্মানিতে প্রবাসী বিশিষ্ট লেখক -সাংবাদিক নাজমুন নেসা পিয়ারি এবং তাদের একমাত্র সন্তান ও সুইস ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আদনান কাদরীর উপস্থিতি এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে ।
প্রণতি পর্ব শেষে প্রতিধ্বনি শুরুর আগে কবিকে ঘিরে আঁকা চিত্রকর্ম, কবির প্রতিকৃতি ইত্যাদির ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। এই সময় তাঁর সাথে আরও ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি নুরে আলম মিনা, শিল্পী কাজী রকিব, ওবায়দুল্লাহ মামুন, নিহার সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান তারিফ, শামসুল আলম বকুল ও টিপু আলম।
প্রণতি পর্বে কাবেরী দাশের পরিচালনায় সংগীত পরিষদের শিল্পীরা, ফেরদৌসি ইকরাম সংগীত পরিবেশন করেন এবং বিপার শিল্পীরা 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' কবিতার সাথে একটি অসাধারন নাচ পরিবেশন করে।
প্রতিধ্বনি পর্বে উত্তর আমেরিকার অন্যতম খ্যাতনামা সেতার বাদক মোরশেদ খান অপুর বাদন সবাইকে সম্মোহিত করে রাখে এই পর্যায়ে সংগীতের মাধ্যমে কবির প্রতি অঞ্জলি নিবেদন করেন কাবেরী দাশ, শপ্না কাওসার ও তাহমিনা মোস্তফা।
পুরো অনুষ্ঠানের দৃশ্যবন্দী ও সংরক্ষণে ছিলেন নিউইয়র্ক বাংলা টিভির মীর শিবলী, আলোক পরিকল্পনার তন্ময় মামুন, শব্দ প্রক্ষেপণে সায়েম, আলোকসম্পাতে শামীম মামুন লিটন, মঞ্চ পশ্ছাদপট ও স্মারক নকশা নজিব তারেক, মন্দিরায় শহীদ উদ্দিন, তবলায় সজীব মোদক ও পরিবেশনায় বিশেষ সহযোগী ছিলেন স্বীকৃতি বড়ুয়া।
বাংলাদেশ সময় ০৯৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৬
এমএমকে