নিউমার্কেট থেকে রিক্সা নেয় অনুপা। হোস্টেলে যাওয়ার পথে পান্থপথ থেকে তুলে নেবে রুদ্রকে।
‘না..কই..। ’ আমতা আমতা করে রুদ্র বলে, তোমার হাতটা একটু ধরা যাবে?
অনুপা মুচকি হেসে উত্তর দেয়, একটু ধরবে! পুরোটা নয়?
অনুপার এমন উত্তরে একটু অবাক হয় রুদ্র। ফেসবুকে যখন প্রথম পরিচয়, তখন কতই না নিশ্চুপ আর লাজুক মনে হতো তাকে! আর এখন.. হাত ধরে অনুপাকে নিজের কাছে টেনে নিলো রুদ্র। এবার যেন একটু লজ্জা পেল অনুপা।
অনুপাকে তার হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে ইউনিভার্সিটির হলে যেতে যেতে প্রায় ১টা বেজে যায় রুদ্রর। হলে পৌঁছে গোসল-খাওয়া সেরে শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়। এর মধ্যে অনুপার কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। কল দেয়। কিন্তু রিসিভ হয় না।
মোবাইল ফোনের ফেসবুক অপশনে ঢুকে পড়ে রুদ্র। অনু বিনু নামের প্রোফাইলে গিয়ে অনুপার ছবি দেখতে থাকে। মনে পরে যায় অনুপার সঙ্গে প্রথম দেখার সেই দিনটির কথা।
দুজনে বসেছিল ধানমণ্ডি লেকে। তাদের সামনে এসে শুকনা মতো একটি লোক বললো, ভাই চা লাগবে? বিড়ি, সিগরেট?
রুদ্র উত্তরে জানিয়ে দেয়, না লাগবে না।
অনুপা বলে, চা নাহলে সিগারেট তো খাবেন। নাকি সিগারেটও খান না আপনি।
আমি সিগারেট খাই না। — রুদ্রর এমন কথায় অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে থেকে অনুপা বলে, সিগারেট না খেলে পুরুষের আবার স্মার্টনেস প্রকাশ পায় নাকি?
রুদ্র ভেবেছিল খুশি হবে অনুপা। তাই বলেছিল এই মিথ্যা। এমনই হিতে-বিপরীত অবস্থা বুঝে সঙ্গেসঙ্গে পকেট থেকে সিগারেট বের করে সে।
দুজনের পরিচয় মাত্র দু’মাসের। এর মধ্যেই দুজন দুজনের কত কাছে চলে এসেছে। তবে কখনও ঝগড়াঝাটিও হয়েছে। এই তো সেদিন। ফেসবুকে চ্যাট করার সময় রুদ্র একটা চুমু চেয়েছিল অনুপার কাছে।
‘পুরুষরা এমনই’। এরকম একটা উত্তর দিয়ে চ্যাটলাইন অফ করে দেয় অনুপা। অনুপার এমন আচরণে বুকের ভেতরটা ধপ করে ওঠে রুদ্রর। অনুপা রাগ করেছে? কী করবে সে। ফোনের পর ফোন। কিন্তু কিছুতেই ফোন রিসিভ করে না অনুপা।
ক’দিন ধরেই রুদ্রের ভীষণ জ্বর। ট্যাবলেট খেয়েও লাভ হচ্ছে না। অনুপার সঙ্গেও কথা হয় না প্রায় এক সপ্তাহ। সব মিলিয়ে একটা খারাপ সময় যাচ্ছে তার। না, অনুপার সঙ্গে যেভাবেই হোক কথা বলা দরকার। এত ঠুনকো একটা অপরাধ নিয়ে অনুপা নিশ্চয় এতো রাগ করতে পারে না।
জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিল রুদ্র। এরমধ্যেই হঠাৎ ওর রুমমেট ঘরে ঢুকে বলে, তোর অনু এসেছে। বাইরে অপেক্ষা করছে।
ওয়েটিংরুমের সোফায় বসা অনুপা। রুদ্র আসতেই অনুপার চোখে পানি চলে আসে— ‘অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। তাই না। স্যারি রুদ্র। আর কখনো এমন হবে না। দেখে নিও। ’
অনুপাকে খুবই সুন্দর লাগছে আজকে। কপালে কলো টিপ। চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে সে। সব মিলিয়ে অন্যরকম লাগছে তাকে। কথা ছিল পূর্ণিমার রাতে তারা একসঙ্গে নৌকাভ্রমণে যাবে।
কথামতো আজই সেই ভ্রমণের রাত। ঢাকার জ্যাম ফেলে দুজনে যখন বেড়িবাঁধে পৌঁছায়, তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাত। দুজন মিলে একটা নৌকা ভাড়া করে কয়েক ঘণ্টার জন্য। নৌকায় উঠেই নাচানাচি শুরু করে অনুপা। নৌকার পারে বসে পানি ছিটিয়ে সে বারবার ভিজিয়ে দেয় রুদ্রকে।
অনেকক্ষণ ধরে রুদ্র কোনো কথা বলছে না। খেয়াল করেই রুদ্রের কাছে গিয়ে বসে অনুপা। বলে, আজ আমার ঋণ শোধ করার রাত। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুদ্রের ঠোঁটের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সে। দীর্ঘ চুম্বনে নিজের ঋণশোধে মগ্ন থাকে অনুপা। সেই কয়েক মিনিট রুদ্র যেন তার ভেতর থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। পূর্ণিমার চাঁদ যেন তার বুকের মধ্যে ধরা দেয় কিছু সময়ের জন্য।
রুদ্রের ঋণ, রুদ্রের দাবী শোধ করে দেয়ার পর অনুপাই প্রথম কথা বলে, জানো রুদ্র, কেন জানি মনে হচ্ছে আজকের রাত শেষ হবে না। রুদ্র হেসে বলে, তুমি পাগল হয়ে গেছ। আর কয়েকঘণ্টা পরই রাত শেষ হয়ে ভোর হবে।
অনুপা বলে, দেখে নিও এই রাত শেষ হবে না।
রুদ্র বলে, তাহলে বাজি হয়ে যাক।
অনুপা বলে ওকে, কী নিয়ে বাজি।
রুদ্র বলে, যদি তুমি জয়ী হও তাহলে ভাববো তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো। আর যদি রাত শেষ হয় তাহলে আমি তোমাকে বেশি ভালোবাসি।
ওকে ডান। আমি রাজি। — জানায় অনুপা।
দুজনের কথাবার্তার একপর্যায়ে নৌকা প্রায় মাঝনদীতে চলে যায়। রাত তখন ১২টার কাছাকাছি। এরই মধ্যে হঠাৎ অনুপা আবিষ্কার করে নৌকায় একটি সাপ রুদ্রের দিকেই ফণা তুলে তাকিয়ে আছে। সে মাঝিকে ডাকতে গিয়ে দেখে সাপটা রুদ্রের আরও কাছে চলে এসেছে। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে নৌকায় থাকা হারিকিনের আলোয় সে বুঝতে পারে, রুদ্র চোখ বন্ধ করে আছে।
অনুপা চিৎকার করে রুদ্রকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সাপটি কামড় দিয়ে বসে অনুপাকে। বিষধর সাপের এমন কামড়ে মুহূর্তেই নীল হয়ে ওঠে অনুপা।
দুজনের বাজিতে সে রাতে দুজনেই তারা জিতে যায়। অনুপার জীবনে আর সেই রাত শেষ হয়নি। অন্যদিকে সেই রাত শেষে আরও অনেক ভোরের দেখা পায় রুদ্র।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৪