ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: অষ্টাদশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
নীল উড়াল: অষ্টাদশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

১৮.
সকালে ঘুম ভাঙতেই বুকটা ধক করে উঠল। বিস্ময়ে চোখ মেলে দেখি সামনেই রোকসানা মূর্তিবত বসে আছে।

স্বপ্ন নয়, সত্যি। বিছানায় সকালে তাজা রোদ তীর্যক খেলা করছে। ‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আখিঁর কোণে’- কবি যাই বলুক, আঁখির কোণে থাকা চিরপুরাতন কাজলের মায়াঞ্জলের অপার্থিক সৌন্দর্যের প্রলেপ মাখা রোকসানাকে দেখে আমি নির্বাক। পুরাতন কাজলে নতুন রোকসানাকে বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখে মনে পড়ল, সব কিছু পুরাতন হয় না। না যৌবন না সৌন্দর্য। ডায়মন্ডস আর ফর এভার।

নীল উড়াল: সপ্তদশ পর্ব

আগুন-শরীরে এই মেয়ে কখন এলো? জানি, ওর কাছে চাবির কপি আছে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে অপেক্ষা করছে। বুঝাই যাচ্ছে, অফিস যাওয়ার পথে রোকসানা সাত সকালে ফ্ল্যাটে হাজির। একদম বিনা নোটিশে। ব্যাপার নিশ্চয় জটিল। ফ্ল্যাটে ওর আসায় কেউ সন্দেহ করবে না। না এনামুল, না অন্য কেউ। অফিসিয়ালি এ ফ্ল্যাটের দেখ-ভাল সে-ই করে। এটা তার দায়িত্বের মধ্যেই বর্তায়। সে অফিসের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য আজ এই ভোর-সকালে আসে নি। কারণ, সে দারুন সেজেছে আজ। আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে যেন তার সর্বাঙ্গ থেকে। মুখে হালকা গোলাপি আভা। ভারী কাজলের আড়ালে নিশুতি রাতের তারার মতো জ্বল জ্বল করছে চোখ। মেদহীন কোমরে আলগা শাড়ির আঁচল। বুকের পাশ থেকে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে অবাধ্য চুল। নিটোল শরীরের স্পষ্ট লাইনিং তুলে ধরেছে সে।

আমি ফ্রেস হয়ে আসা অবধি ঝিম মেরে বসে রইল রোকসানা। সাজসজ্জার পরেও চেহারাটা আজ এতো ম্লান কেন ওর? দুঃখিত ভঙ্গিতে খানিক ঝুঁকে আছে। আমি এসে খাবার টেবিলে বসতেই, সে-ও সপ্রতিভভাবে উঠল। আমাকে নাস্তা তৈরিতে সাহায্য করছে। ডাইনিং টেবিলে পাশাপাশি বসে টোস্টে বাটার লাগিয়ে দিল। এক সময় আস্তে আস্তে বলল:
-এসএমএসটা মুছে ফেলেছেন?
আমি মাথা নাড়িয়ে বলি:
-হু।
রোকসানা ভারী শ্বাস ফেলে বললো:
-জানতে চান না কি বিপদ আপনার? কেন আপনার বন্ধুর চাকরি করেও আপনাকে সাহায্য করছি?
আমি ওর মুখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে বলি:
-আমি জানি, তুমি নিজেই বলবে।
হাল্কা চমকে উঠল রোকসানা। বলল:
-কিভাবে জানেন?
আমি কিছুটা দার্শনিকতা মেশানো গলায় বলি:
-চাকরির তুমিই সবটুকু তুমি নয়, আমি সেটা জানি। আরও জানি, তোমার আসল ‘তুমি’ আমার কাছে আসবেই।

ছলছল করে উঠল রোকসানার দু’চোখ। হাত বাড়িয়ে আমার হাতটি ধরলো সে। হাতের তালুতে নখের আঁচড় কাটতে কাটতে বলল:
-আপনাকে সেক্সচুয়েলি এক্সপ্লোয়েট করা যাবে না। আপনাকে দেখেই সেটা আমি বুঝেছি। আপনি অন্য রকম মানুষ। অন্য রকম মনের মানুষ। আপনার কথা ভাবলে মন উছলে ওঠে। মনে হয়, পবিত্র বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে নিজের অন্তর।

আনমনা রোকসানা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সে এখন নিজের মধ্যে নেই। উদাস চোখে জানলা দিয়ে দূরের আকাশ দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলতে লাগল:
        তোমাকে চেয়েছি, এ কথা তো নতুন নয়
        আবাসী বৃক্ষের মতন ঠাঁইনাড়া আছি
        তবুও কেন স্পর্শ করো না
        বৃথা জোছনা গড়িয়ে গেছে বহুদিন
        পাথর ভেঙেছে সমুদ্র-উচ্ছ্বাস
        তাও জেনেছি
        তবুও কেন স্পর্শ করো না
        স্পন্দনের শব্দে ফেটে যায় চিতা-কাঠ
        উড়ে পুড়ে পড়েছে শরীর জুড়ে
        তবুও কেন স্পর্শ করো না
        তোমাকে চেয়েছি, এ কথা তো নতুন নয়
        ঘুম-সুখে ছুঁতে চেয়েছি, এ কথা তো নতুন নয়
        তবুও কেন স্পর্শ করো না...।

আমি আস্তে করে রোকসানা গালে টোকা দিলাম:
-এই মেয়ে! অত মন খারাপ করতে নেই। দিস ইজ নট য়েন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড।
রোকসানা সম্বিত ফিরে পেল:
-ওহ!
আবার বললাম:
-কি হয়েছে তোমার? আমায় বলো?

রোকসানা নিজের খুবই গভীর থেকে উচ্চারণ করলো:
-আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এই ভোগ, এই নেশা, এই লালসা, এই আনন্দ মনে হয় একেঘেঁয়ে, ক্লান্তিকর।
বলতে বলতে সে যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। আমি তাকে বলি:
-মন যা চায়, সেটাই করো। মনের বিরুদ্ধে চাপ দিয়ে কিছু করবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোকসানা বললো:
-আমার মন, আমার শরীর আর আমার নেই। আমি বিক্রি হয়ে গেছি, বন্দি হয়ে গেছি।
হু হু করে একটি কান্নার দমকা বেগ বের হয়ে হলো রোকসানা শ্বাসযন্ত্র থেকে। সে ভাঙা-গলায় বললো:
-জানেন, মন চায় আমি শুধু একজনকে গভীর ও পবিত্রভাবে ভালোবাসি; সে-ও শুধু আমাকে নিয়ে থাকুক। অথচ আমি প্রতিক্ষণ পবিত্রতা হারাচ্ছি। নিজেকে হারাচ্ছি। হাত বদল হয়ে যাচ্ছি।

আমি ওকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি:
-রোকসানা, নিজের উপর আস্থা হারানো পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ভুল। বাইরে থেকে ভেতরের কনফিডেন্স ফিরে পাওয়া যায় না। তুমি কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উঠে আসা মেয়ে। আমার বিশ্বাস, এক সময় ঠিকই তুমি নিজেকে ফিরে পারে।

মেয়েটি মনে হয় নিজের মধ্যে প্রবল আলোড়নে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। আমার করতল তার দু হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিল। তারপর জড়ানো গলায় বললো:
-আর বোধ হয় হবে না। আমি যে জালে জড়িয়ে গেছি, সেখানে প্রবেশ সহজ, প্রস্থান কঠিন।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে বলি:
-তবু তোমাকে তোমার মতো আত্মসম্মানের সঙ্গে স্বাধীনভাবে বাঁচার পথ খুঁজে বের করতেই হবে।
আবার লম্বা সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রোকসান। ধীরে ধীরে বললো:
-ছোটবেলায় যখন নামতা মুখস্ত করেছি, চেঁচিয়ে বলেছি, এক দু’ গুণে দুই। দুই দু’ গুণে চার। কিন্তু কারও কারও জীবনের অঙ্ক বোধ হয় মেলে না। আমি অঙ্ক না-মেলা অভাগাদের দলে।
আমি পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলি:
-দেখো মেয়ে, পরীক্ষা বা জীবনে অঙ্ক কখনওই নিজে নিজে মেলে না। সেটাকে মেলাতে হয়। হয়ত তুমি চেষ্টা করো নি। করলে অবশ্যই পারবে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমি থাকি না কেন, আমাকে তোমার পাশে পাবে। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। বলো, কি জন্য সকাল বেলা চলে এলে?
রোকসানা বলে:
-যে জন সবসময় মানুষকে সাহায্য করতে উন্মুখ, তাকে কোনও সহযোগিতার দরকার হয় না। আপনি মানুষের জন্য কাজ করছেন। আপনার সাহায্য মানুষ পাবে। আপনাকে সাহায্য করার দরকার নেই। শুধু বলতে পারি, খুব বিপদ নিয়ে কাজ করছেন। বিপদ আপনার খুব কাছেই উৎ পেতে আছে। সতর্ক থাকবে। তবে...
খানিক থেমে, কি যেন ভেবে, রোকসানা আবার বললো:
-আপনাকে যতটুকু দেখেছি, জেনেছি, আমার বিশ্বাস, আপনি পরাজিত হবেন না। হয়তো আপনি নিঃশেষ হয়ে যাবেন, তবুও হার মানবেন না।

আমি হাসলাম। ওর হাতের বন্ধন থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। রোকসানা হাত ছাড়ল না। বুকের সঙ্গে আরও জোরে ধরে রাখলো। তারপর আমাকে ভীষণ অবাক করে আমার আরও কাছে এসে নিজের মুখটা আবার বুকে রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলল। আমি ক্রন্দসী মেয়েটির মাথার চুলে আলতো হাত বুলিয়ে মৃদ্যু কণ্ঠে বললাম:
-ইটস ওকে। সব ঠিক হয়ে যাবে রোকসানা।

বেশ সময় পর সে মুখ তুলল। স্বাভাবিকভাবে আমার দিকে তাকাল। ওর বিষণ্ন চেহারায় অন্য রকম দ্যুতি। সম্ভবত জীবনে এই প্রথমবার, একেবারে অনাস্বাদিত একটি অনুভূতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে রোকসানাকে। একটা খুশি খুশি, পবিত্রতা মাখা, ঈষৎ গর্ব মেশানো চরিতার্থতাবোধ তাকে আলোর বলয় দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এই প্রথম বুঝি কোনও পশুশ্রমচেতনা এসে টুঁটি টিপে ধরতে পারল না এই অস্থির, আত্মনিয়ন্ত্রণহীন মেয়েটিকে। বিবেকের দায়বদ্ধতা ওর লুকানো অপরাধকে সংহার করেছে।    

ফোটা ফোটা ভালোবাসা নিয়ে এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। আমি বিড়বিড় করে আবৃতি করি:
যখনই খুঁজেছি মেঘগরজনে তোমার পায়ের শব্দ
তুমি নও শুধু বকুল গন্ধে বৃষ্টি এসেছে।

আমি আর রোকসানা জানালার কাছে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, বর্ষারাতের টানা গর্ভসঞ্চারের পর সকালের কাঁচা সোনা রৌদ্রের শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে তুমুল বর্ষণ। সুরমা-রঙা মেঘপুঞ্জ টুকরো টুকরো ভালোবাসা হয়ে ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টি নিজেই জানে না কতদিন পর এ রকম নিবিড় আশ্লেষে মেঘকে কাছে টেনেছে। আমিও জানি না। রোকসানাও না। শুধু জানি বৃষ্টি। চারিদিকে বৃষ্টি। বাইরে-ভেতরে প্রবল বৃষ্টি।
        বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
        আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান ॥
        মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
        এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান ॥
        আজ এনে দিলে, হয়ত দিবে না কাল
        রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
        এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
        ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান। চলবে

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ