ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: ষড়বিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
নীল উড়াল: ষড়বিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

২৬.
যথেষ্ট দৌড়-ঝাঁপ হয়েছে। শরীরের উপর দিয়েও ধকল কম যায় নি।

তথ্য-উপাত্ত প্রচুর পরিমাণেই আমার নোট খাতায় জমা পড়েছে। ফ্ল্যাটে বসে ক’দিন লিখতে হবে। এক ফাঁকে মার্গারেটকে মেইল করি। কাজের অগ্রগতি জানাই: ‘আমি যে বিষয়ে জানতে চাচ্ছি, ধীরে ধীরে সেটার রহস্য দরজা খুলে যাচ্ছে। ’ জেনে মার্গারেট খুশি হলো। ওর কাছ থেকে উত্তর পাওয়া মানেই এক ধরনের আনন্দদায়ক প্রণোদনা। ওর ফিরতি মেইলের শেষ লাইনটি আমার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চের দোলায় কাঁপিয়ে দিল। মার্গারেট লিখেছে, ‘আমি ঢাকায় আসছি। খুব সহসাই তোমার সঙ্গে দেখা হবে। জাস্ট ওয়েট। ’ আমি মনে মনে বললাম, ‘য়্যু আর সো নাইস, মার্গারেট। না বললেও মনের কথা ঠিক টের পেয়ে যাও। ’

নীল উড়াল: পঞ্চবিংশ পর্ব

শব্দে মনোযোগ ছিন্ন হলো। ঘরে ইন্টারকম বাজছে। এখন আবার কে? বেশ অবাক হয়ে ফোন তুলে জানতে চাই:
-কে?
ফোনে খিলখিলিয়ে উঠলো উচ্ছসিত নারী কণ্ঠ:
-হাই। মলি বলছি। ফ্রি থাকলে বলেন, আমি আসব? না আপনি আসবেন?
কি যন্ত্রনা! এই ভর সকালে কেমন জ্বালাতন!
বিরক্তি চেপে বলি:
-আমি খুব জরুরি কাজ করছি। থ্যাঙ্কু ফর কল অ্যান্ড ইনভাইটেশন।
ফোন রেখে দিতে আমি যে ভদ্রভাবে ইঙ্গিত করছি, সেটা মেয়েটি গায়েই মাখলো না। সে আগ্রাসী গলায় বললো:
-ওকে। অ্যাম ওয়েটিং।
আমিও বললাম:
-ওকে। আমি রাখছি।
মলি ফোন রাখতে দিল না। প্রায়-চিৎকারের মতো করে বললো:
-জাস্ট অ্যা মিনিট। ফোন রাখবেন না, শুনুন, আজ দুপুরে আমাদের এখানে খাচ্ছেন আপনি। আন্টি সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। না এলে কেলেঙ্কারী হবে কিন্তু।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে-ই লাইন কেটে দিল।

আমি হতবাক হয়ে ভাবছি, কি চাচ্ছে মেয়েটি? আমাকে নানা ভাবে ইঙ্গিত দিয়ে দেখেছে, আমি সাড়া দিচ্ছি না। তবুও কি চায়? শুধু চায় বললে ভুল হবে। জোরপূর্বক চায়। দাবি নিয়ে চায়। ফোনে মলির শেষ লাইনটিতে সুপ্ত হুমকি লুকিয়ে আছে। আমার কাছে মলি এবং তার আন্টি নামক চরিত্রগুলো বিভ্রান্ত বোধ করার জন্য যথেষ্ট বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাছোড়বান্দাদের একটি মতলব থাকে। এদের ‘মতলব’ কি? আমাকে শুধু শুধু হয়রানি করার পাত্র এরা নয়! নিশ্চয় পেটে অন্য ফন্দি আছে। ঠিক আছে, দেখি কি চায়! সিদ্ধান্ত নিলাম, ওদের ওখানে যাবো, এক সাথে খাবো এবং কথা বলে ওদের সাইকি ও মটিভ বুঝতে চেষ্টা করবো। আরেকটি বিষয় খেয়াল করতে হবে-পারপাস। টিকে থাকার নাগরিক ঘোড়দৌড়ে কোনও মানুষই অহেতুক কিছু করে না। এরাও বৃথা সময় নষ্ট করছে না আমার পেছনে। ওদের পারপাস বুঝতে হবে।  

দুপুরের মুখে মলিদের ফ্ল্যাটে ঢুকে আমি স্তম্ভিত। সম্পূর্ণ এয়ারকন্ডিশন্ড। মেঝেতে ইতালির মার্বেল পাথর। ড্রয়িং রুমে অসংখ্য ক্রিস্টাল স্ট্যাচু। অর্ধ নগ্ন নারীর নানা ভঙ্গিমা। একদিকের দেওয়ালে উত্তেজক বিরাট তৈলচিত্র: এক নগ্নিকার উন্মুক্ত বক্ষ পিঞ্জরে থোকা থোকা গোলাপ।
আমাকে রিসিভ করতে করতে মলি আহ্লাদি গলায় বললো:
-শেষ পর্যন্ত এলেন?
মলির পেছনে আন্টি এসে আমাকে নিয়ে সোফায় বসতে বসতে নিজেও পাশে বসেছেন। তার দিকে চেয়ে আমি উত্তরে বলি:
-এমনভাবে ডাকলে না এসে পারা যায়? আপনি কি বলেন, আন্টি!
আঁতকে উঠলেন ভদ্রমহিলা:
-নো আন্টি। সোস্যালি আই মে বি আন্টি। বাট পার্সোনালি য়্যু কল মি জেনি, জেনিফার।
আমিও তার সাবলীলতাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে বলি:
-ওকে জেনি।

খুশি হলেন জেনিফার। মধ্য তিরিশের কোন মেয়ে নিজেকে আন্টিতে রূপান্তরিত করতে চায়! ঘরোয়া পোশাকে তাকে দেখাচ্ছেও তরুণীর মতো। পিঙ্ক টপসের সঙ্গে তিনি পরেছেন একটি কালো ম্যাক্সি। শরীরের জৌলুস ঠিকরে বেরুচ্ছে। মলিও ততক্ষণে পাশে এসে বসলো। সঙ্গে আরেকটি মেয়ে। আমার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতে মলি বললো;
-মিট মাই ফ্রেন্ড পরী।
সর্বাঙ্গে লাল রঙের আগুনে ঔজ্জ্বল ভরা মেয়েটি আমাকে ‘হাই’ করলো। আমি ভেবে পাই না, লাল কেন? পরীর সঙ্গে তো মায়াবী, স্বপ্নীল নীল রঙ মানায়। কিন্তু সে নিজেকে ঢেকে রেখেছে আগুন দিয়ে। তার শরীরের আগুন আর পোশাকের আগুন একাকার হয়ে আছে। অন্য দিনের চেয়ে মলিও বেশ খোলতাই আজ। সে পরেছে একটি ব্রাউন শর্টস আর ইয়েলো টি শার্ট। ওর পুষ্ট গোলাপী স্তন আটোসাটো টি শার্টের হলুদের সঙ্গে মিশে অদ্ভুত নেশা-ধরা একটি কালার ইমেজ তৈরি করেছে।

নিরবতা ভেঙে জেনিফার জানতে চাইলো:    
-তা কেমন চলছে আপনার দিনকাল?
আমি তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ি। আমার মৌনতায় জেনিফার খুশি হলো না:
-আপনি বড্ড কম কথা বলেন? কি ব্যাপার বলুন তো?
আমি নিরস কণ্ঠে উত্তর দিই:
-না, তেমন কিছু না। আমার টাইপটাই এ রকম।
যেন আমাকে জেরা করছে এমন ভঙ্গিতে জেনি বললো:
-ও, আই সি। আপনাকে পার্সোনাল প্রশ্ন করি? ইফ য়্যু অ্যালাউ মি?

পাশে যে দুটি সোমত্ত তরুণী ক্যাজুয়ালি বসে আসে, সে খেয়াল না করেই জেনিফার আমার ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাচ্ছে। আশ্চর্য! কিংবা এসব খেয়াল করবার দরকার তার নেই। এটাই তার কাছে স্বাভাবিক। আমি পাশে তাকিয়ে দেখি, মলি ও পরী বিকারহীন বসে আছে। ভাবখানা এমন যে, ‘তোমাদের কাজ তোমরা কর, আমরা কিছু মনে করছি না। ’ এরা কি আসলেই আত্মীয়, নাকি ফেক? আমার উত্তর পেতে দেরি হলো না মলির কথা শুনে:
-ডিয়ার জেনি, রিলাক্স। বেচারাকে এডজাস্ট করতে দাও। প্রথমেই চেপে ধরো না।

চোখের মাদকতা পুরো শরীরে ছড়িয়ে মলি খিলখিলিয়ে উঠল। যেন নিজের কথাতেই নিজে ভীষণ মজা পেয়েছে। পরী পাশে বসে আক্রমণাত্মভাবে শরীর দোলালো। সে জিবের ডগা নীচের ঠোঁটের কোণে নাচিয়ে আলতো করে নিজের ঠোঁট কামড়ে রেখেছে।
এবার জেনিফার বললো:
-ওকে ওকে। আপনার সঙ্গে আসল পরিচয়টা হয়ে যাক।
দু’ হাত স্তনের নীচে আড়াআড়িভারে রেখে শক্ত হয়ে বসে জেনি আরও বলল:
-আমরা হলাম হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’-এর কুত্তাওয়ালী। আন্টি-নিস-আত্মীয়তা কিছু না। ফালতু আড়াল।
আমার হা করা মুখের অবাক অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে জেনি দুষ্টামী মাখা হাসি দিয়ে আরও বললো:
-ইয়েস মিস্টার। উই আর হেয়ার ফর বিজনেস। এই বাড়ি-ঘর কিছুই আমাদের নয়। আমরা শুধু সেক্স অ্যান্ড এনজয়ের জন্য। আমাদের কোনও পুঁজি নেই। মূলধন নেই। নিজেকে দিয়েই নিজের কমফোর্ড নিশ্চিত করছি।

আমার চিন্তা-ভাবনার প্রতিটি প্রকোষ্ঠ যেন ভূমিকম্পে খান খান করে আমার উপরেই ভেঙে পড়ছে। উদভ্রান্তের মতো আমি তিন যুবতীর মুখ দেখছি। আমার ভেতরের স্পর্শকাতরতা ওরা গ্রাহ্যই করলো না।

জেনি কণ্ঠ নাচিয়ে বললো:
-কি হলো মিস্টার? আপনি তো এখনও যথেষ্ট ইয়াং আছেন। আমাদের আপনার ভালো লাগছে না?
মলি আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানতে চাইলো:
-বি ফ্রি। এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। নিজেকে এক্সপ্রেস করুন।
আমার মাথা ঝুঁকে এলো। মনে হচ্ছে মেঝের সঙ্গে মিশে যাবে। কাদের পাল্লায় পড়েছি আমি! ঘৃণায় আমার বমি বমি লাগছে।

অবাক হওয়ার আরও অনেক বাকী আছে আমার। নাটকীয় ভঙ্গিতে পরী মেয়েটি পায়ের কাছে এসে মাটিতে বসে পড়ল। আলতো হাতে আমার চিবুক উঠিয়ে ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বললো:
-আচ্ছা আপনি তো এখানে একা থাকেন। আপনার সেক্সুয়্যাল প্লেজার কি ভাবে এনশিউর করেন?

মিষ্টি একটি মেয়ে। প্রেম বা ভালো লাগার কোনও দিক স্পর্শ না করেই যৌনানন্দ উপভোগের খবর জানতে চাইছে! আমি তার দিকে বোকার মতো চেয়ে রইলাম। আমি কোনও কথা বলতে পারছি না। আমি কি নিথর হয়ে গেছি? নিজেকে নিজেই ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে।
ওরা মনে হয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছে। তিনজনই তিনজনের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে তাকালো। চোখের ভাষায় নিজেদের মধ্যে কি এক আলোচনা সেরে নিল। বেশ খানিক পর জেনিফারের গলা শুনতে পেলাম:
-ওসব কথা থাক। আপনার সঙ্গে এ নিয়ে এগুনো যাবে না। কাজের কথায় আসি। জেনুইন বিজনেস টক।
আপনার সকল ইন্দ্রিয় এক সঙ্গে জেগে উঠল। পৃথিবীর আদিম ব্যবসার ক্ষেত্র থেকে আবার কোন ব্যবসার জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে এরা।
আমি উৎসুকভরা চোখে জেনিফারের দিকে তাকাই। অনেকক্ষণ পরে গলায় স্বর ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করি:
-কোন কাজের কথা বলছেন আপনি?
জেনিফার সবজান্তার মতো উত্তর দিল:
-যে কাজের জন্য আপনি এদেশে এসেছেন? দিন-রাত ছুটে বেড়াচ্ছেন, সেই কাজ।
ওরাও তাহলে সব জানে। আমি নিজেকে চেপে রেখে বলি:
-ও। তা চলছে মোটামুটি।
আমার উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে জেনিফার ফের বলে:
-মোটামুটি নয়। যথেষ্ট গভীরে পৌঁছে গেছেন। আপনি বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী লোক। ‘ক’ বললে ‘কলকাতা’ বুঝেন। বাংলাদেশের ড্রাগ বিজনেস সিন্ডিকেটকেও আপনি বুঝে ফেলেছেন।

আমি না জানার ভঙ্গিতে এই রহস্যময়ী নারীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। জেনিফার আসলে কি বলতে চাইছে, সেটা জেনে নেওয়া দরকার। আগেই মুখ খুললে ওর কথা বলার ফ্লো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি অপেক্ষা করি ওর বাকী কথা শোনার জন্য। মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারে না, বেশিক্ষণ চুপও থাকতে পারে না। আমি আশা করছি, এই প্রবাদটি সত্য হোক। জেনি আমাকে হতাশ করলো না। খুব স্পষ্টভাবে বললো:
-টিকে থাকার জন্য আমাদের নানা কিছু করতে হয়। ঘরের ভিতর বিছানা পেতে রাখতে হয়। নিজেকে বিছিয়ে দিতে হয়। নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে আসতে হয়। সমাজের উচ্চ স্তরের নানা পেশা ও বৃত্তির লোকের চাহিদা মেটাতে হয়। নিজেদের এবং ক্লায়েন্টদের প্রোটেকশন ও সিকিউরিটি দিতে হয়। এজন্য ক্ষমতার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখতে হয়। ওদেরকে খুশি করতে হয়। পয়সার জন্য সেক্সের বাইরেও ড্রাগস ও ক্রিমিন্যালদের সঙ্গে আমাদের প্যাক্ট রাখতে হয়। মাল্টি-পারপাস ব্যাপার। চলুন, আপনাকে দেখাই।

জেনিফার হাত ধরে আমাকে ফ্লাটের ভেতরে নিয়ে গেল। বিরাট ফ্ল্যাট। অনেকগুলো কক্ষ হোটেলের মতো খাট পেতে সাজানো। কয়েকটি কক্ষের পর জেনিফার একটি ওয়াল কেবিনেটের সামনে আমাকে নিয়ে দাঁড়ালো। এক টানে কেবিনেটের পাল্লা খুলে ফেললো সে। কেবিনেটের অভ্যন্তরে তাকিয়ে আমার দু’ চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। থরে থরে সাজানো বিদেশি মদ, ড্রাগস, ইয়াবা, ভায়েগ্রা। নীচের তাকে এক স্তুপ অস্ত্র। পিস্তল, রিভলবার, শর্ট গান। কেবিনেটের এক কোণে দেশি-বিদেশি কারেন্সি স্তরে স্তরে সাজানো।

জেনিফার নির্দ্বিধায় বলে চলেছে:
-এসব এখন ব্যবসার অঙ্গ হয়ে গেছে। সেক্স-ড্রাগস-ক্রাইম-ভায়োলেন্স-মানি। সংঘবদ্ধ চক্কর। একটি আরেকটিকে সাহায্য করে। একটি আরেকটির সাহায্য নেয়। আমরাও হেল্প নিই। হেল্প করি। তা না হলে সমাজের এতো উঁচুতে এতো নিরাপদে টিকে থাকতে পারবো না। সব কিছু করছি। অথচ কেউ আমাদের কিছুই করতে পারছে না। পারবেও না। চেষ্টা করলে ‘বাকের ভাই’-এর মতো বেঘোরে মারা পড়বে।
খুব অনেস্টলি জানার জন্য আমি জিজ্ঞেস করি:
-বাকের ভাই কে?
তিনজনের মিলিত হাসি শুনতে পেলাম। যেন আমার মুখ থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জোকস বের হয়েছে। ওদের হাসি থামতেই চাচ্ছে না। বহু কষ্টে হাসি আটকে জেনিফার বলল:
-বাকের ভাই হলেন আপনার কার্বন কপি। তিনি ছিলেন লোকাল রবিনহুড। আর আপনি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টেলেকচুয়াল। দু’ জনেই নিজের বৃত্তের বাইরে শক্তি দেখাতে চায়। একজন নাটকের মধ্যে মারা গেছে। আরেকজন বাঁচবেন না মরবেন, ঠিক করতে পারছেন না।
আবার তিনজনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি যেন কোনও ভৌতিক সার্কেলে জড়িয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে চলছে প্রেতদের উৎসব-উল্লাস। তিন যুবতী আমাকে স্কট করার মতো আবার এনে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসালো। জেনিফার এবার বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললো:
-আশা করি পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে আঁচ করতে পারছেন।

এদের মনোভাবের পরিচয় জানতে হলে আর চুপ থাকা ঠিক নয়। আমি মুখ খুলি:
-আমাকে কি করতে হবে?
আমার কথা শুনে আনন্দিত গলায় জেনিফার বললো:
-গুড ম্যান। ভেরি গুড ম্যান।
তিনজনই ভয়ানক খুশি হলো। জেনিফার সিরিয়াস কণ্ঠে এবার বললো:
-আপনার সব ইনফরমেশন আমাকে দিয়ে দিন। এসব বন্ধ করে নিজের পথে চলে যান। আমি পার্টির সঙ্গে কথা বলে আপনার জন্য উপযুক্ত টাকার ব্যবস্থা করবো।
আমি জিজ্ঞেস করি:
-সেটা কি রকম?
আমাকে ব্যাখ্যা করে জেনি বলে:
-লাইক অ্যা বিজনেস ডিল? আপনি তথ্য বেচে টাকা কামাবেন। আমরা ব্যবসার মধ্যস্থতা করে দিচ্ছি মাত্র। আমাদেরও কিছু লাভ হবে।
আমি আবার জানতে চাই:
-আপনাদের লাভ?
মাথা ঝাঁকিয়ে জেনি বললো:
-আছে আছে। ঊভয় পক্ষের কাছ থেকেই কমিশন পাবো। আর এই কাজটা করে দেওয়ার জন্য আমাদের এসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে।
আমি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করি:
-কে দিয়েছে?
সতর্ক গলায় জেনিফার বললো:
-আমরা পার্টির নাম বলি না। ট্রেড সিক্রেট। নাম না বললেও আপনি জানেন বা জেনে যাবেন। এটা আমার বিশ্বাস। যে লোক একা ও নিরীহভাবে আস্ত একটি গ্রুপ ও সিন্ডিকেটকে ভড়কে দেয়, সে নিজেই সব জেনে যাবে।

আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর ধীরে ধীরে বলি:
-ওকে জেনিফার। আমি আপনার প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবো। আমাকে একটু সময় দিন।
আমার কথা গ্রহণ করে জেনিফার বললো:
-নো প্রবলেম। আপনি যেখানেই যান, যা-ই করুন, আমাদের চোখের আওতাতেই আছেন। আমরা মানে এই তিনজন নই। আমরা মানে আপনার বিপক্ষের সবাই। সেক্স-ড্রাগস-ক্রাইম-ভায়োলেন্স-মানি সিন্ডিকেটের সকল লোক। সো, আপনাকে আপাতত ছেড়ে দেওয়া যায়। বাট, আমাদের কথায় রাজি না হলে মস্ত বড় ভুল করবেন, এ কথাটা মাথায় রাখবেন।

আমার জন্য এখন প্রধান কাজ হলো এদের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসা। আমি মৌন সম্মতির হাসি হেসে উঠে দাঁড়ালাম। ওরা নির্বিঘ্নে দরজা খুলে আমাকে আন্তরিকভাবে বাই করলো। খুবই প্রোফেশনাল। কাজে পেশাদারিত্ব আছে।

মলিদের ফ্লাটের বাইরে এসে আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তির স্বাদ পেলাম। আমার মনে হলো, শুধু এই ফ্লাটেই নয়, পুরো দেশটাই সেক্স-ড্রাগস-ক্রাইম-ভায়োলেন্স-মানি সিন্ডিকেট কৃষ্ণচক্র দিয়ে ঘিরে রেখেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ