ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: চতুর্ত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৭
নীল উড়াল: চতুর্ত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩৪.
ঝড়ের বেগ পেয়েছে সাইফুলের ‘উড়াল যাত্রা’। সে চাপা আতঙ্কে বললো:
-স্যার, এখন কই যামু?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না।

মার্গারেটের ওখানে যাওয়া যাবে না। সে জায়গা চিনে গেছে প্রতিপক্ষ। এনামুলের ফ্ল্যাটে যাওয়া মানে ইচ্ছে করে ফাঁদে আঁটকানো। অন্তরার কথা মনে পড়ল। ছোটখালার মুখ ভাসছে। ওদের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু....। মন সায় দিল না। আমার বিপদে ওদেরকে টেনে এনে কি লাভ!

সাইফুল তাড়া দিল:
-স্যার, কিছু কন! কি করুম?
হতাশ গলায় আমি সাইফুলকে আমার মনে কথাটাই বলে ফেলি:
-আমার কোনও জায়গা নেই সাইফুল। এই শহর আমার জন্মস্থান,  কিন্তু আমি এখানে আশ্রয় পাচ্ছি না। আমি জানি না কোথায় যাবো।
সাইফুল একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো:
-আল্লাহ ভরসা। যার কেউ নাই, তার আল্লাহ পাক আছেন। দেখি কি করা যায়। কিছুক্ষণ চক্কর দিয়া দেহি। মাথায় কিছু আসে কি না।

রাতের মুখে আলো ঝলমল রাজধানীর পথে সাইফুলের ‘উড়াল যাত্রা’য় আমি নিজেকে লুকানোর প্রচেষ্টায় উদভ্রান্ত। আহা! আমার শহর! আমার স্বদেশ! আহা স্বদেশ! একখণ্ড পোড়ো জমি হয়ে গেছে আমার জন্য। আশ্রয়হীন। আমি কি এলিয়টের কবিতার অংশ হয়ে যাচ্ছি? কিংবদন্তির কোনও সত্ত্বা? আমি কি এই জগতের বাইরে চলে যাচ্ছি। এখানে আমার কেউ নেই। এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতার মূল প্রতীক ‘পোড়ো জমি’ মেছোরাজার কিংবদন্তি থেকে আহৃত। ‘ফিশার কিং’ বা মেছোরাজা তার যৌন অমিতাচারের কারণে দেবতার কোপে পড়েন। দেবতার অভিশাপে শারীরিক পঙ্গুত্ব ও পুরুষত্বহীনতা ভর করে রাজার ওপর। তিনি প্রজননক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। শুধু রাজা নন, তার রাজত্বের সকল পশুপাখি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। সকল জমি হয়ে যায় নিষ্ফলা। জলরহিত মরুময় তরুলতাহীন সেই বিরাণভূমিতে কোনও পাখি গান গায় না। ফুল ফোটে না। শুধু জন্মায় বিষম-বিষণ্ন ক্যাকটাস।

আমি কি একটি পোড়ো মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছি? যেখানে সব কিছু বন্ধ্যা? প্রজননহীন? অক্ষম? প্রতিবাদের ভাষা বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই? মেছোরাজার পোড়া দেশের প্রেতাশ্রিত ভাঙা গির্জায় আগত নাগরিকদের অক্ষম কান্নার মতো শব্দ এখন চারদিকে। সবাই আত্মসমর্পন করেছে। কিন্তু না, বিনা যুদ্ধে কিছুই ছাড়া যাবে না। আমি লড়বো। লড়তে লড়তে প্রয়োজনে আত্মদান করবো। পরাভব মানবো না।
আমার অভিব্যক্তিতে মনে হয় দ্রোহের কোনও স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে। ড্রাইভার সাইফুল চমকে জিজ্ঞেস করে:
-স্যার, কি হইলো?
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলি:
-আর পালাবো না। আমি লড়াই করবো।

সাইফুল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। কথা বলতে পারছে না। বলে কি এই মানুষ! যার চারদিকে শত্রুর মিছিল, সে কিনা একাকী লড়াই করবে? মাথার ঠিক আছে তো? নাকি বিপদে পইড়্যা বিগড়াইয়্যা গেছে! সে শান্তভাবে বলে:
-স্যার, মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। বিপদে ধৈর্য্য ধরনের হুকুম আছে। আগে জান বাঁচান। পরে ফাইট দিয়েন।
আমি ধমকে উঠি:
-কি বলতে চাও তুমি?
সাইফুল আমাকে প্রশান্ত গলায় বলে:
-স্যার, আমরা বেবুঝ মানুষ। অত বুঝি না। তয়, এইড্যা বুঝি যে জান আগে। পরে অন্য কিছু। যদি বেয়াদবি না নেন, একখান কথা কই...
সাইফুল কথা থামিয়ে আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করে।
আমি সম্মতি জানাই:
-বল!
সে বেশ সরলভাবে প্রস্তাব দেয়:
-স্যার আমার মনে হয়, আপনি ঢাকা ছাইড়্যা দেন। কয় দিন দূরে গিয়া গা ঢাকা দিয়া থাকেন। আপনের শত্রুরা তখন খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত হইয়া ঝিম ধরবো। হেই ফাঁকে আপনি আপনের কাম গোছাইবেন।     

আমি মনেযোগ দিয়ে সাইফুলের কথা শুনছি। কিন্তু এই রাত্রে কোথায় যাবো? দেখি সাইফুল কোনও বুদ্ধি বাৎলাতে পারে কিনা? তাকেই জিজ্ঞেস করি:
-কোথায় যাওয়া যায় বলো?
সাইফুল হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললো:
-স্যার, এখন চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনার দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাস-ট্রেন ছাড়তাছে। আপনি কুনু একটিতে ঘাপটি মাইৠা চইল্যা যান। কয়েক দিন পরে আবার আসেন।
আমি আর ভাবতে পারছি না। আমার ভাবনার চেয়ে দ্রুততায় শত্রুপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বরং কোথাও সরে যাওয়াই ভালো। সাইফুলকে বলি:
-সে ব্যবস্থাই করো।

সাইফুল খুশি হয়ে সিএনজির দিক পরিবর্তন করতে করতে বললো:
-আমার মতে বাসের চেয়ে ট্রেন ভালো। বাস থামাইয়্যা চেক করন যায়। ট্রেনে চেক কম। চিটাগাঙের ট্রেনে উঠেন স্যার। একটানে পার।

সিএনজি এখন কমলাপুর স্টেশন চত্বরে। একটি ছায়াময় আড়ালে গাড়ি রেখে সাইফুল নেমে এলো। সে আমাকে নামতে দিল না:
-স্যার আপনে গাড়িতেই লুকাইয়্যা থাকেন। আমি টিকেট-পত্রের ব্যবস্থা করি।

বাসের টিকিট সহজে পাওয়া গেলেও ট্রেনের পাওয়া যায় না। সাইফুল ব্ল্যাকে একটি টিকেট ম্যানেজ করে ফেলে। গাড়ি ছাড়ার অল্পক্ষণ আগে সে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। আমি সিএনজি থেকে নামতে যাবো, এমন সময় মোবাইলে ম্যাসেজ বিট বাজছে। মার্গারেট লিখেছে, ‘তোমাকে না পেয়ে আমার উপর চাপ বাড়াচ্ছে। অ্যাটাকও হতে পারে। কয়েক দিন সরে থেকে যোগাযোগ করো। পাল্টা কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটা ভাবতে হবে। এক তরফা মার খাওয়া উচিত হবে না আমাদের। শামীমকে ওটা দেওয়া হয়েছে। টেক কেয়ার। ’

সাইফুল তাড়া দেয়:
-গাড়ি ছাইড়্যা দিব স্যার! জলদি করেন।
আমি তাড়া খেয়ে দ্রুত সিএনজি থেকে নেমে আসি। হুড়োহুড়িতে মোবাইল পড়ে থাকে পিছনের সিটে। আমি খেয়ালও করি নি যে, জরুরি যন্ত্রটি আর সঙ্গে নেওয়া হলো না। সাইফুল আমাকে ট্রেনের পথে চলতি মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঠেলে দিতে দিতে বলে:
-স্যার জলদি যান, জলদি...

আমি মানবস্রোতের সঙ্গে প্লাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছি। পেছনে সিএনজির সঙ্গে দাঁড়িয়ে সাইফুল। ওর চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি। আমাকে যতক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ট্রেন ছাড়ার শব্দ শুনে সে সিএজিতে উঠে বসে। স্টার্ট দেয়। হঠাৎ পেছনে খেয়াল করে দেখে, স্যারের মোবাইল। আহা রে...। সাইফুল আফসোস করে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আর দেওয়ার উপায় নেই। সে অতি যত্নে স্যারের মোবাইল বুক পকেটে রাখে। কাজের জিনিস, দেখা হলে ফেরত দিতে হবে।

‘উড়াল যাত্রা’ এখন বাড়ির পথে। বউ, পোলাপান নিশ্চয় চিন্তা করছে। বিপদের মুখে বের হয়েছে সে, চিন্তা তো করবেই।

কমলাপুর ছেড়ে কিছুটা এগুতেই সাইফুলের খটকা লাগে। শাহজাহানপুর কলোনির মধ্যে এসে তার ভীতি আরও বাড়ে। কয়েকটা মোটরসাইকেল যেন তাকেই ফলো করছে। বেশি দূর এগুতে পারে না সে। তিনটি মোটরসাইকেল সিএনজির সামনে এসে তার পথ আটকায়। থেমে যায় ‘উড়াল যাত্রা’। তিন সাইকেলে দুইজন করে ছয়জন বসা। কলোনির আধো-অন্ধকারে কারও মুখই ভালো করে দেখা যায় না। একজন নেমে এসে সিএনজির চারপাশে চক্কর দেয়। মোটরসাইকেলের আর কেউ নামে না। সবাই চক্কর দেওয়া দেখছে। সাইফুল ভাবে, সিএনজি চক্কর দেওয়ার কি আছে? ছিনতাই করলে তো ড্রাইভারকে ধরবে। এরা আজব চক্কর দিতাছে ক্যান? তিন চক্কর দিয়ে লোকটি পিছনের সাইকেলের একজনকে বলে:
-এইটাই ওস্তাদ।

এবার ওস্তাদ কিসিমের একজন মোটর সাইকেল থেকে নেমে আসে। প্রথম লোকটি তার হাতে একটি ছোট যন্ত্র দেয়। যন্ত্রটিতে পিট পিট করে বাতি জ্বলছে আর নিভছে। দ্বিতীয় লোকটি যন্ত্রটি সাইফুলের শরীরের কাছে আনে। বেশি পরীক্ষা করতে হলো না। বুক পকেটের কাছে নিতেই যন্ত্রের শব্দ পরিবর্তন হয়ে ঘড়ির অ্যালার্মের মতো হয়। লোকটি সাইফুলের পকেটে হাত দিয়ে স্যারের মোবাইলটি বের করে নিজের হাতে নিয়ে বলে:
-এইডা পাইছস কই?

সাইফুলের বুঝতে অসুবিধা হয় না, লোকগুলো স্যারের খোঁজে এসেছে। সাইফুল সামান্যই ভাবার সুযোগ পেল। তার আগেই লোকটি তার শার্টের কলার চেপে ধরেছে। এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে যাবে। সে বুঝলো,  স্যারের কথা বললে সব ফাঁস হয়ে যাবে। স্যারের আর রক্ষা নাই। কোথাও না কোথাও তাদের লোক ট্রেনে উঠে স্যারকে ধরে ফেলবে। স্যারের কথা কিচ্ছু বলা যাবে না। স্যারকে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতেই হবে।

লোকটি সাইফুলের গলা আরও জোরে চেপে বলে:
-ক শালা! এইডা পাইছস কই?
বহু কষ্টে উত্তর দেয় সাইফুল:
-এইডা আমার।
লোকটি ধমকে উঠে:
-হাচা কথা ক?
সাইফুল কঁকিয়ে বলে:
-হাচাই, আমার।
লোকটি সাইফুলের গলা ছেড়ে দিল। পেছনে ফিরে মোটরসাইকেলের অন্য সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললো:
-তগর কি মনে হয়, ফোনটা ওরই?
একজন উত্তর দেয়:
-চেহারা যেমন কইছে, মিলে নাই তো?
আরেকজন বলে:
-চেহারার কি দরকার? মেআপ করছে শালা। পলানোর সুবিধার জন্য সিএনজিঅলা সাজছে?
অন্য আরেকজন খেঁকিয়ে উঠল:
-অত কথার কি কাম! যার কাছে এই মাল পাওয়া যাইবো তারে খতম করতে অর্ডার দিছে। কাম শেষ কইৠা দিলেই হয়।

এ কথায় সাইফুলের রক্ত হিম হয়ে আসে। সে লাফিয়ে সিএনজি থেকে নেমে ওস্তাদ লোকটির পায়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে:
-আমারে মাইরেন না ওস্তাদ। আমার বাল-বাচ্চা আছে। খোদার কসম আমি কিছু করি নাই।

একটি লাথি দিয়ে সাইফুলকে সরিয়ে দেয় ওস্তাদ লোকটি। সাইফুল আবার এসে তার পা চেপে ধরতে চায়। পারে না। পিছন থেকে একজন ছুরির একটানে তার গলা এফোড়-ওফোড় করে ফেলে। সে কোরবানির গরুর মতো গোঙাতে থাকে। তার কণ্ঠ থেকে ঘড় ঘড় শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। বহু কষ্টে সে সিএনজিতে উঠতে গিয়েও পারে না। গাড়িসহ উল্টে পরে যায়। তার তখন স্যারের কথা মনে পড়ে। ছেলে-মেয়ের মুখ ভেসে আসে। বউয়ের ছবি চোখে ভাসে। আহা! সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। রাতে খেতে খেতে মজা করে কত কথাই না আলাপ করা যেতো বউ-বাচ্চাদের সাথে: ‘বউ জানস! কেউ ধরতে পারে নাই তোর পোলার বাপ রে। স্যারেরে সহি-সালামতে পার কইর‌্যা আইছি। স্যার লোকটা বিশ্বাস কইর‌্যা আমার কাছে আইছিল। আমি ঈমানদারির সাথে কাম করছি। ঠিক করি নাই বউ!’ নিশ্চয় বউ হাসবে। সঙ্গে পোলাপানগুলো হেসে উঠবে। সাইফুলের খুব ইচ্ছা করে বউ-বাচ্চাদের মুখের মিষ্টি হাসি দেখতে।

সে কোনও হাসি দেখতে পারে না। নিকষ অন্ধকারে তার পুরো জগত কালো হয়ে আসে। মরে যাওয়ার আগে সাইফুলের মনে হয়, সে তার শরীরের সব রক্ত দিয়ে ‘উড়াল যাত্রা’কে যুদ্ধের সাজে সাজাচ্ছে। তার প্রাণের ‘উড়াল যাত্রা’ যুদ্ধে যাবে। বড় পবিত্র সে যুদ্ধ!  

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ