ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

নীল উড়াল: সপ্তত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৭
নীল উড়াল: সপ্তত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩৭.
মার্গারেট আমাকে দেখে উত্তেজনা ও আনন্দে উল্লসিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে কাছে এলো। কিছু বলার বা শোনার আগে সে আমাকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলো।

কতক্ষণ জাপটে ছিল, বলতে পারবো না। আমাকে দেখে সে খুশিতে ঝলমল করছে।

নীল উড়াল: ষড়ত্রিংশ পর্ব

দিন সাতেক অন্তর্ধানের পর রাতের গাড়িতে ঢাকায় পৌঁছেই সাত-সকালে স্টেশন থেকে সরাসরি আমি মার্গারেটের কাছে চলে এসেছি। ফোন বা অন্য কোনোভাবে আগাম খবর দেওয়া সম্ভব হয় নি। আমার সঙ্গে মোবাইল না থাকায় মার্গারেটের পক্ষেও যোগাযোগ করার সুযোগ হয় নি। গত সাত দিন আমি ছিলাম সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে কিনা, সেটাও সকলের আন্দাজের বাইরে ছিল। নিরুদ্দেশ থেকে কিংবা না ফেরার দেশ থেকে আচানক কেউ আবার চলে এলে যেমন হয়, আমাকে পেয়ে মার্গারেটের পৃথিবী তেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমাকে দেখে সে প্রথমে কিছুটা বিহ্বল আর রোমাঞ্চিত হয়েছে। তারপর প্রথম যে কথাটি বললো সে:
-এতো দিন কেমন ছিলে?

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে আমার এলামেলো চেহারা-ছবির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো:
-কি অবস্থা হয়েছে তোমার?
আমাকে কিছু বলতে দিল না সে। নিজেই বলতে লাগলো:
-আগে ফ্রেস হয়ে নিজেকে ঠিক করো। তারপর জরুরি কথা আছে। আমরা প্ল্যান ঠিক করে রেখেছি। হাতে সময় কম। জলদি তৈরি হয়ে নাও।

কয়েক দিনেই নিজের প্রতি যথেষ্ট অনাচার হয়েছে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতেও পারছি না। আমি চটপট নিজের চেহারা-ছবি আগের মতো গুছিয়ে নিলাম। এখন আমাকে বেশ তাজা লাগছে। নিজের মধ্যে অনুভব করছি চনমনে ভাব। প্রিয় সান্নিধ্যের উষ্ণতা বদলে দিয়েছে মনের কালো মেঘ ও বেদনা। একাকিত্বের দাহ শেষে এসেছে প্রিয় শাওন। নিমিষেই ক’দিনের অনিয়ম ও ধকলের চাপ কেটে গেছে। মার্গারেটের কাছে আসায় আমার একাকিত্ব ও পলাতক জীবনের শেষে সাহস সঞ্চারিত হয়েছে। আমি এখন আবার যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। কফি নিয়ে আমরা মুখোমুখি বসেছি জরুরি আলোচনার জন্য। আমি সরাসরি জানতে চাই:
-বলো মার্গারেট, কি পরিকল্পনা করা হয়েছে?

মার্গারেট কোনও ভূমিকা ছাড়াই বললো:
-তোমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের করতে আমরা দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা বলেছে, মামলা কোর্টে উঠলে আইনগত সহযোগিতা দেবে। কিন্তু আমি যতদূর খবর নিয়েছি, তাতে মামলার প্যাঁচ থেকে তোমাকে বের করা প্রায়-অসম্ভব। তোমাকে অ্যারেস্ট হতেও দেওয়া যাবে না। তাহলে তোমার জীবনের বিপদ দেখা দেবে।
আমি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলি:
-তাহলে কি করতে হবে?
মার্গারেট অবিচল ভাবে জানায়:
-আমরা পিছিয়ে যাবো।
আমি একটু উচ্চস্বরেই চেঁচিয়ে উঠি:
-তার মানে? কি বলতে চাচ্ছো তুমি?

মার্গারেট বুঝলো, কথাটি আমার পছন্দ হয় নি। সে একটু সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করলো:
-তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। আগেই তুমি কিন্তু উত্তেজিত হবে না। পুরোটা শুনে নাও। তারপর তোমার মত জানাও।
আমি এবার একটু শান্ত ভাবে বলি:
-আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বলো। আমি শুনছি।
মার্গারেট ধীরে ধীরে বললো:
-দেখো, যুদ্ধের ময়দানে কৌশলগত পশ্চাৎদপসরণ বলে একটি কথা আছে। সেখানে পিছিয়ে যাওয়া মানে পরাজিত হওয়া নয়। পিছিয়ে গিয়ে আবার তৈরি হওয়ার নাম ‘কৌশলগত পশ্চাৎদপসরণ’। আমাদেরকে এখন সেটাই করতে হবে।
আমি ওর কথা মানতে পারি না। প্রতিবাদ করে বলি:
-আমাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে বলছো? অসম্ভব!
মার্গারেট হাসলো। সে মৃদু কণ্ঠে বললো:
-তুমি ভুল বুঝেছো। পালানো বা যুদ্ধ ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসছে না। বরং আমরা বড় আকারে যুদ্ধ শুরু করেছি।

আমি কিছু বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সে বলে:
-তোমার রিপোর্টের কপি ও বিভিন্ন পত্রিকার ক্লিপিং আমি আমার হেড অফিসে পাঠিয়েছি। তারা সেটা গ্রহণ করেছে। আমরা আন্তর্জাতিক মিডিয়া, জাতিসংঘের মাদক বিরোধী সংস্থার মাধ্যমে গ্লোবাল ক্যাম্পেইন শুরু করবো এখানকার মাদকচক্রের বিরুদ্ধে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবো। এখানকার পুরো সিস্টেমই আমাদের বিরুদ্ধে। এখানে থেকে লড়াই করার অর্থ হচ্ছে একতরফা মার খাওয়া। শক্তি ও কৌশলে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের আরও শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। কৌশলজনক অবস্থান নিতে হবে।

মার্গারেট আরো বললো:
-তুমি জেনে খুশি হবে যে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে এখানে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। মাদকচক্র আপাতত ঘাপটি মেরে আছে। এই ফাঁকে আমাদের সরে যেতে হবে নিরাপদ স্থানে। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
আমি জানতে চাই:
-কি ব্যবস্থা করেছো?
মার্গারেট বললো:
-আমাদের তানিয়ার এক কাজিন পুলিশে আছে। সে সব শুনে আমাদের ইজি প্যাসেজ দিতে রাজি হয়েছে। তার সাহায্যে ভিন্ন নামে তোমার একটি পাসপোর্ট বানিয়ে আমরা অতি দ্রুত দেশ ছেড়ে যাবো। এখানে আটকে থাকলে আমার নিরাপত্তাও মাদকচক্রের লোকজন চরমভাবে বিঘ্নিত করবে। তানিয়ার পুলিশ কাজিনই আমাকে সে সব কথা জানিয়েছে। অতএব আপাতত ‘কৌশলগত পশ্চাৎপদসরণ‘ ছাড়া উপায় নেই।

আমি কোনো কথা বলছি না। ভাবছি মার্গারেটের কথা। সে মিনতি ভরা গলায় বললো:
-প্লিজ, আমাকে ভুল বোঝ না। আমি তোমার এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত থাকবো। তুমি আর না করো না। রাজি হয়ে যাও। প্রয়োজনে মাদকচক্রের হোতাদের আইনের জালে আটকে আমরা আমার ফিরে আসবো। তুমি স্বাধীন, মুক্ত ও নিরাপদ ভাবে তোমার স্বদেশে আসবে।

আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। নিজের জন্মভূমি থেকে বেনামে পালানোর মতো অপমান আর কি হতে পারে! এই যন্ত্রণা আমি ভুলবো কেমনে? তবু অস্তিত্বের লড়াইয়ের প্রশ্নে মার্গারেটের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি? আমার মধ্যে তীব্র হঙ্কারে যুদ্ধের দামামা বাজছে। কিন্তু সরাসরি রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবেলা এখনই সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধের ছকটা খানিক বদলাতে হবে।    

আমি শেষ পর্যন্ত সম্মতি জানাই:
-মার্গারেট, তুমি যা ভালো মনে করো, সেটাই হবে। আমি আপত্তি করবো না।
মার্গারেট খুশি লুকিয়ে রাখতে পারলো না। সে তৎক্ষণাৎ তানিয়াকে ফোন করে কিছু ইনস্ট্রাকশন দিল। আধা ঘণ্টার মধ্যে তানিয়া ক্যামেরা নিয়ে হাজির। সে আমার ছবি তুললো এবং একটি পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে দিলো। আমি মার্গারেটের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। সেও মাথা ঝাঁকালো। অন্য একটি নাম-পরিচয়ে আমি ফরম পূরণ করে তানিয়ার হাতে দিলাম। তানিয়া কালবিলম্ব না করে চলে গেলো। মার্গারেট আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। মাথায় হাত রেখে চুলে আঙুল চালিয়ে আদরে ভরে দিচ্ছে সে। আমি আবেশে চোখ বুজে আছি। সে কানে কানে চুপিসারে বললো:
-এখন তোমার একটিই কাজ! লুকিয়ে থাকা।
আমি অবাক হয়ে বলি:
-কোথায় লুকাবো?
মার্গারেট দু’ হাতে আমার গাল স্পর্শ করে লাজুক গলায় বললো:
-আমার কাছে। আমার ভিতরে।    

হঠাৎ যেন চারপাশটা ফরাসি সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠলো। আমি মাতালের মতো দু’ হাত বাড়িয়ে দিই মার্গারেটের দিকে। মনে হলো, দূরে কোথাও ঝড় হচ্ছে। পাগলা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছে ঘরের জানালায়। আমরা ভেজা বাতাস গায়ে মাখবো বলে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় চলে আসি। নক্ষত্রের চলাফেরার ইশারায় চারিদিকে ঘনিয়েছে সাঁঝের মায়া। দিনের শেষ আলোর পরশ-মাখা বাতাসে ফিকে-সবুজ হয়ে এসেছে প্রান্তরের ঘাস। দূর দিগন্তে আলোর আবীর-রঙা মশাল হাতে ছুটছে মেঘ-মঞ্জুরির ভেলা। এই সময়, সম্ভবত, কাঁচপোকারা ঘুমিয়েছে। গঙ্গাফড়িং, সে-ও ঘুমে। আম, নিম, হিজলের ছোঁয়ায় এখনই নামবে বর্ষণ। আমার আজ ভীষণ ইচ্ছা করছে ভিজতে।

মার্গারেট মেঘলা বাতাসে চুল উড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর অপলক দৃষ্টিতে আমার প্রতিচ্ছবি। বৃষ্টির তরুণ কয়েকটি ফোটা নেমে এসেছে আকাশের নীচে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি। মার্গারেট এখন চঞ্চল বৃষ্টিবালিকা।

মুষল বৃষ্টিতে সব স্মৃতি, সব দুঃখ, ভেসে যাচ্ছে। কোনো আক্ষেপ নেই। অভিমানও। আর একবার না হয় নতুন করে সব শুরু করা যাক। আমি মার্গারেটের দিকে হাত বাড়িয়ে বলি, ‘আমার কবিতা আজ তোমার গীতের সাথে মেঘের নুপূর...তুমি আর আমি চলি বৃষ্টির হাত ধরে দূর-বহুদূর...। ’

মার্গারেট আমার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিজেকে মেলে দেয়। তার বুকের ভেতর থেকে বসন্ত বাহারের মতো কথামালা ওপরে উঠে গেলে সন্তর্পণে আরও ভারী হয়ে ওঠে মেঘের ডানা। ওর শরীরের মুদ্রায় শুরু হয় মেঘেদের গর্জন। এরপর ছবিতে আঁকা পরীদের প্রতীক হয়ে সে আর্দ্র বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ে আমার মর্মমূলে। হঠাৎ তার দু’চোখের তারায় ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ। ঠিক তখনই আকাশ ফুটো হয়ে নামে অ-নে-ক উদ্ধত বৃষ্টি। সোনারঙের ফসল ফলে আমার বুকে লুকিয়ে থাকা হেমন্তের মাঠে। এ বৃষ্টি আর কারো নয়, আমার আর মার্গারেটের।

আমরা দু’জন ভেতরে ও বাইরে তুমুল ভিজতে থাকি অন্তবিহীন বৃষ্টির সঙ্গীতে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৭
জেডএম/  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ