এই ইতিহাস দূরবর্তী কালের হলে তার মূল্যায়ন অপেক্ষাকৃত সহজতর, আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে এই দূরত্বের জন্য অনেক সময়ই ঐতিহাসিক অনেক উপাদান হারিয়েও যেতে পারে। সাম্প্রতিককালের ইতিহাস রচনায় এই প্রতিবন্ধকতা থাকে না, যদিও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তা বিতর্কিত হতে পারে।
এতসব ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের প্রায় ২২ বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পশ্চাদ্ভূমি যেভাবে মোস্তফা কামালের দুটি উপন্যাসে বাস্তব চিত্ররূপের চেহারা পেয়েছে তা পাঠকের কাছে এক প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল মনে হবে; আসলে উপন্যাস দুটি একটি সিরিজের মতোই, যা হয়তো লেখকের পরবর্তী উপন্যাসে সম্পূর্ণ হবে, প্রথমটির নাম ‘অগ্নিকন্যা’, দ্বিতীয়টি ‘অগ্নিপুরুষ’।
অনেক স্বপ্ন, লোভ, হতাশা, ক্ষোভ, যন্ত্রণা আর রক্তগন্ধ নিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত দুই টুকরো হলো। ভারত ও পাকিস্তান, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই নানা জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছিল। একদিকে ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষমতার লড়াই, অন্যদিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অবরুদ্ধতার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির লড়াই। এই লড়াইকে সমূলে বিনাশের জন্য পাকিস্তানের সরকার যে দমনপীড়নের নীতি গ্রহণ করেছিল এবং সেই রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, তারই দৈনন্দিন চিত্রমালা এই দুটি উপন্যাসে এতটাই বিশ্বস্তভাবে আঁকা হয়েছে যে মনে হয় যেন মোস্তফা কামাল প্রতিটি ঘটনার সময় ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন। এই বিশ্বস্ততা গড়ে তোলার জন্য প্রচুর পরিমাণে তথ্য-সন্ধান ও সংগ্রহের পরিশ্রম করতে হয়েছিল লেখককে, যা তিনি ভূমিকা অংশে নিজেই জানিয়েছেন। কিন্তু উপন্যাস তো তথ্যভাণ্ডার নয়; সেই তথ্যকে কাঠামো করেই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক উপন্যাসে গড়ে ওঠে প্রতিটি চরিত্র। এখানেই ঔপন্যাসিকের দক্ষতা। কামাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, শুধু চরিত্র সৃষ্টিতেই নয়, কাহিনি বয়নে এবং পরিস্থিতির বর্ণনায় যে দুরন্ত গতিতে তিনি উপন্যাস দুটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তা প্রায় বাস্তব স্মৃতিচারণার মতোই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছে। দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে দেখা দিয়েছিল অসন্তোষ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে অস্বীকার করে খাজা নাজিমুদ্দীনকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী করে দেন তা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহল মেনে নিতে পারেনি, জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিদেরই ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়োগ করেন। প্রায় একই সঙ্গে বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার তাগিদ ও অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিকাশপর্ব অগ্নিকন্যা উপন্যাসের পটভূমি, ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬---এই কালপর্বে বাংলাদেশের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনীতি, সমকালীন নেতাদের বিচক্ষণতা, ভ্রান্তি, ষড়যন্ত্র, আত্মত্যাগ ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের তীব্রতা নাটকীয় বাস্তবতায় যেভাবে এ উপন্যাসে পরিবেশিত হয়েছে, তা এককথায় এক অনবদ্য ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের আকর।
‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসটি সম্পর্কেও একই কথা খাটে। আসলে উপন্যাসটি ‘অগ্নিকন্যা’রই পরবর্তী খণ্ড বলা যায়। এখানে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯--এই কালপর্বের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিটিই সক্রিয়। বলা বাহুল্য, তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি।
শ্রেণিবিচারে দুটি উপন্যাসই রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক উপন্যাস। তাই আইয়ুব খান থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, ভাসানী প্রমুখের রাজনৈতিক মানসলোক ও সক্রিয়তাই এখানে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সাংবাদিক থেকে পুলিশ-আমলা এমনকি রিকশাওয়ালাকেও ওই একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা; শুধু অগ্নিপুরুষ, জনগণনেতা, শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপন্যাসের উপকাহিনির চরিত্র তিনটি এর ব্যতিক্রম। টুকরো টুকরো অজস্র ঘটনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক কামাল মুজিবের দূরদৃষ্টি, নেতৃত্ব দানের আশ্চর্য ক্ষমতা, আপসহীন আদর্শবাদী সংগ্রামী ব্যক্তিত্বকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তাঁর স্নেহার্দ্র হৃদয়, পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ, স্ত্রী রেণুর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও সন্তানস্নেহের চিত্রমালা রচনা করে চরিত্রটিকে পূর্ণতা দিয়েছেন। মহৎ এক জননেতার স্বাভাবিক দৃঢ়তা, তিতিক্ষা ও অসামান্য দহন-সহিষ্ণুতাও চরিত্রটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ঐতিহাসিক বাস্তবতার সুর অক্ষুণ্ন রেখেই লেখক এই চরিত্রটির ক্রমবিকাশে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। একজন সৎ রাজনৈতিক কর্মীকে রূপান্তরিত করেছেন একটি দেশের জনপ্রিয়তম দেশ নেতায়। মনে হয়, এই সিরিজের পরবর্তী উপন্যাসে এভাবেই আমরা চরিত্রটিকে দেখতে পাব স্বাধীন বাংলাদেশের জনকরূপে। নির্ভেজাল রাজনৈতিক কাহিনির সমান্তরালে এই দুটি উপন্যাসেই একটি উপকাহিনি এগিয়ে গেছে। সম্ভবত, এই অংশই উপন্যাসের সম্পূর্ণ কাল্পনিক অঙ্গ, উচ্চপদস্থ এক পুলিশ অফিসারের মেয়ের নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলনের নেত্রী হয়ে ওঠার কাহিনিই এই উপকাহিনির বিষয়; মতিয়া নামের এই মেয়েটি গণ-আন্দোলন করতে গিয়ে যে নির্ভীক মানসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর, আন্দোলনে শামিল হয়ে একসময় সে ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, তার সরকারবিরোধী ক্রিয়াকর্মের জন্য পুলিশ অফিসার বাবার কর্মক্ষেত্রে সে সংকট দেখা দিয়েছে, তা অনায়াসে মিটিয়ে দিয়েছে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে এক সাংবাদিককে বিয়ে করে। বৃহত্তর আদর্শের জন্য মতিয়া জেলে গেছে কিন্তু কোথাও বিন্দুমাত্র আপস করেনি। চরিত্রটি প্রায় সম্পূর্ণত আদর্শায়িত, যদিও অবিশ্বাস্য নয়। একদিকে শাসকের শোষণ-পীড়ন, ষড়যন্ত্রের কুটিল হিংস্র আবহ, অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে নিরলস আত্মত্যাগী গণ-আন্দোলনের যে রাজনৈতিক ইতিহাস এই দুটি উপন্যাসে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে ফুটে উঠেছে তা যেকোনো দেশপ্রেমিক পাঠকের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। একজন সৎ ঔপন্যাসিকের ধর্ম মেনেই কামাল এ দুটি উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ অনুসন্ধানের যে কঠিন শ্রম স্বীকার করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
বিশেষত, নতুন প্রজন্মের কাছে দুটি উপন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটি দেশের জন্মের ইতিহাসে অনেক কিছুই আড়ালে ঢাকা পড়ে; সেখানে থাকে শুধু ফলশ্রুতির সংবাদ বড়জোর তার পটভূমির কিছু অংশ। সেদিক থেকে এই অপূর্ণতাকে সম্পূর্ণতা দিতে পারে এজাতীয় রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক উপন্যাস।
#লেখক: বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক
অগ্নিকন্যা-অগ্নিপুরুষ: মোস্তফা কামাল। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। প্রকাশক: পার্ল পাবলিকেশনস্, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়; ০৯৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৮
জিএম/