আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাগৈতিহাসিক মানুষ, এমনকি মানুষে বিবর্তনেরও আগে বানর, শিম্পাঞ্জি, বনমানুষ বা ওরাংওটাংদের মাঝে গসিপিং বা পরচর্চার প্রচলন ছিল। তথ্য শেয়ার করার প্রয়োজনে সৃষ্ট এ পরচর্চাই মানুষের প্রকৃতিতে সামাজিক সহায়ক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন ও তাকে দৃঢ় করেছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষকরা বলেন, আমাদের সবচেয়ে নিকট আত্মীয় বনমানুষদের সাজগোজ, একে অপরের চুল স্পর্শ এবং অবাঞ্ছিত উকুন খোঁজার সময় মূলত পরচর্চা করতে দেখা যায়। এটি বনমানুষদের জন্য পরস্পরকে তাদের অঙ্গীকার প্রদর্শনেরও একটি ভালো উপায়।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রবিন ডানবার বলেন, সাজগোজ প্রাইমেটদের প্রাথমিকভাবে একটি স্বাস্থ্যকর বিষয় বলে মনে হয়। কিন্তু এটির পেছনে একটি সামাজিক উদ্দেশ্য ছিল, যা প্রাইমেট, এমনকি মানুষের বিবর্তনকেও ত্বরান্বিত করেছে। পরচর্চা প্রথম হাইপোথিসিস, যা সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতেই প্রসূত বলেও মনে করেন ডানবার।
তিনি বলেন, প্রাইমেটদের এ গসিপিং মানুষের মধ্যে আরও গভীরভাবে পুনর্বহাল হয়, যা আরও মানব সদস্যদের দল গঠন ও সমাজবদ্ধ হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে প্রয়োজন অনুসারে আমরা কিছু অতিরিক্ত প্রক্রিয়া সংযোজন করেছি, যা যুগান্তকারী ও অধিক কার্যকরী’। প্রাচীন মানুষের ডিএনএ’র জেনেটিক গবেষণা থেকেও নতুন অর্ন্তদৃষ্টি লাভ হয়েছে। গবেষকদের মতে, সামাজিকতার জিন আমরা আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সরা পেয়েছি আমাদের সমসাময়িক নিয়ান্ডারথালসহ অন্যান্য আদি মানুষের কাছ থেকে। নিয়ান্ডারথালদের ভাষা ও অনুরূপ ক্ষমতা বিকশিত হয়েছে গসিপিং দিয়েই।
যুক্তরাজ্যের সেন্ট অ্যান্ড্রুস ইউনিভার্সিটির ক্লস জুবারবিউহেলার মনে করেন, ‘গসিপিং বর্তমান সময়ে দূষিত মনে হতে পারে, কিন্তু এটি খুব ইতিবাচক একটি দিক, যা সমাজ গঠন ও সাজিয়েছে’।
‘প্রাকৃতিক উৎস থেকে জন্ম নেওয়া এই পরচর্চা একটি কথ্য মিথস্ক্রিয়ার একটি শারীরিক এক প্রতিস্থাপন, যা একইসঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে আবদ্ধ’।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রবিন ডানবার বলেন, ‘আমাদের মানব বিবর্তনের জন্য তো বটেই, যে চ্যালেঞ্জ জগতের লোক আমাদের দিকে নিক্ষেপ করেছে, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং বড় বড় গ্রুপে অভিব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি পরচর্চার মধ্য দিয়েই’।
১৯৯০ সালে প্রথম এ ধারণা জনপ্রিয় হয় যে, পরচর্চা আমাদের সামাজিক বন্ধন বজায় রাখতেই প্রয়োজন। সেবার দার্শনিক জুলিয়ান বাগিনী বলেন, ‘পরচর্চা একটি অন্যান্য মানুষের নৈতিক মূল্যায়ন। এবং অন্যরা কি করছেন, না করছেন, সেটি ভুল না ঠিক, ভালো না খারাপ তার বিশ্লেষণ- এ কথা সত্য। পাশাপাশি এটিও সঠিক যে, মানুষকে নানা উদ্ভাবনী উপায়ে তা আরো সামাজিক হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে। এবং এর উৎপত্তির গল্পও আকর্ষণীয়। কারণ, গসিপিং ও আমাদের নিজস্ব ইতিহাস পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল’।
যুক্তরাজ্যের ইস্ট লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামেলিয়া পাওয়ার এখন প্রাগৈতিহাসিক ও বর্তমান শিকারি ও সংগ্রহকারী মানব প্রজাতিগুলোকে নিয়ে গবেষণা করেন। তার মতে, ‘আগুনের চারপাশে তারা যে গল্প বলছে, গানের সঙ্গে নাচ হিসাবে যে ধর্মানুষ্ঠান পালন করছে, সেসবের জন্য তাদেরকে একটি বাস্তব মানসিক সংযোগ দিতে হয়। আর এসব আলাপ ভালো ফল বয়ে আনছে, যা তাদের সমাজ ও বন্ধনকে শক্তিশালী করছে’।
বাংলাদেশ সময়: ০২১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৬
এএসআর