ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

ঈশ্বরের দু’পা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২২
ঈশ্বরের দু’পা

বিদেশে বিশ্বপর্যায়ের যে কোনো টুর্নামেন্ট কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করবেন। টাইম ডিফারেন্সের সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখাটা ঠিকমতো ধরানোর জন্য তাদের খেলা চলতে চলতে নানানরকম হেডলাইন মাথায় খেলাতে খেলাতে  যেতে হয়।

পুরস্কার বিতরণ শেষ হল। সব  শুনলেন। তারপর ধীরে সুস্থে শিরোনাম ভাবলেন-সেটা এম্ব্যাপেকে পেনাল্টি বক্সে ছেড়ে রাখার মতো মৃত্যুকামী বিলাসিতা।

দুটো ম্যাচে কোনো তুলনাই  হয় না। আজকেরটা শতাব্দীসেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল। অন্যটা যত বাহারিই হোক পাঁচ দলের ওয়ান ডে প্রতিযোগিতার  ফাইনাল। তবু শারজায় সেই জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কার ম্যাচ রিপোর্টের মতো আজ প্রতিনিয়ত বদলেছে। এম্ব্যাপের দ্বিতীয় পেনাল্টির পর শেষ হেডলাইন ল্যাপটপে কম্পোজ  করে রাখি। জানতাম এটাই ব্যবহার হবে। বিশ্বশ্রেষ্ঠ প্রেমকাহিনীর সেই ভাঙা কাঁচের  টুকরো।

প্রথম প্যারাও  লেখা হয়ে যায়। জীবনে কিছু কিছু ঘটনা এমনই অদৃষ্টনির্দিষ্ট থাকে যে যতরকম ফুল ফোটানোরই চেষ্টা হোক। যাত্রাপথ  যত বাহারি আর ঐশ্বরিক দেখতে লাগুক।  ভবিতব্য ঠিক সেই ধুসর,বাঁকাচোরা  গলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে অন্তহীন রোমান্সের পেটে ছুরি চালিয়ে দেয়। কাহিনীগুলো অমর হয়ে থাকে। কিন্তু শেষ হয় ট্র্যাজিক বিন্দুতে।

লায়লা-মজনু।  
রোমিও -জুলিয়েট।
মার্ক আন্টনি -ক্লিওপেট্রা।
টাইটানিকে রোজ  এন্ড জ্যাক।  
লিওনেল মেসি ও বিশ্বকাপ।

কে জানত যে মারাত্মক ভুল। আধুনিক পৃথিবীর ফুটবল ঈশ্বরকে প্রাচীন প্রেমকাহিনী  বা ক্ল্যাসিকসের নিরিখে মাপতে নেই। ঈশ্বর তাঁর নিজের মতো করে মর্ত্যের রাজমুকুট ছিনিয়ে নেন। নইলে আজকের অমর ফুটবল রাত বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে আবির্ভূত হয়?

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর গোল্ডেন বল পুরস্কার নিতে গিয়ে  মেসির হেঁটে যাওয়া যতদিন বেঁচে থাকব মনে থাকবে। জীবজগতে কোনো মনুষ্য বিশ্বসেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে এমন নিস্পন্দ,রক্তশূন্য  আর প্রাণহীন ভাবে এগিয়ে যেতে পারে- না দেখলে বিশ্বাস হত না। আর এদিনকার মেসি ? কাপ আর একগাল হাসি নিয়ে এমন নাচতে নাচতে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে অলরেডি জড় হয়ে যাওয়া তাঁর টিমমেটদের দিকে এগোচ্ছিলেন যেটা বিশ্বকাপ আর্কাইভে নিশ্চয়ই  চিরকালের জন্য ফ্রেমবন্দি থাকল।

শুধু তো বিশ্বকাপ নয়। শুধু তো গোল্ডেন বল নয়। আর একটা সূক্ষ্ম খেলায় তিনি বহুদিনই অনিচ্ছাসত্ত্বেও জড়িয়ে গিয়েছেন- গোটের লড়াই। খুব কম মেম্বার এই ঐতিহ্যশালী ক্লাবে। কারণ গোট হলো গ্রেটেস্ট প্লেয়ার অব অল টাইম। ক্লাব ফুটবলের মুকুটহীন অধীশ্বর হয়েও স্রেফ দেশকে মারাদোনার মতো বিশ্বকাপ দিতে পারেননি বলে কোথায় একটা কর্ণ সিন্ড্রোমে রেখে দেওয়া হতো মেসিকে। লুসেইল স্টেডিয়াম তাঁকে আগের কয়েকটা কঠিন ম্যাচ জিতিয়ে লাকি মাঠের সংস্কারে ঢুকছিল। রোববার রাতে সূতপুত্র থেকে বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনে রূপান্তরিত করে গেল। ফুটবল ইতিহাসের এমন মোহিনী রাত কবে এসেছে যে এক ৩৫ বছরের আপাত বৃদ্ধ ফুটবলার চূড়ান্ত প্রতিকূলতা এবং বিপক্ষ যৌবনের উদ্দাম দাপাদাপি সামলে স্থিতধী এবং জয়যুক্ত থেকে সিংহাসনে বসলেন?

সকালে স্যার জিওফ হার্স্টের ইন্টারভিউ নেটে দেখে অবাক লাগলো। হার্স্টকে গত কুড়ি বছর ধরে ইন্টারভিউয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমনিতে সেই কোন প্রাচীন কালে তিনি বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে। ১৯৬৬-তে যে খেলতো তার ইন্টারভিউ পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ  হওয়া উচিত। কিন্তু হার্স্ট এখনো এমন ঠাটবাটে থাকেন যে ম্যানেজার অতিক্রম করে পৌঁছনোই যায় না। স্বদেশীয় কাগজে এদিন তাঁর সাক্ষাৎকারের বক্তব্য হল এই ৮১ বছর পৌঁছে  প্রার্থনা করছেন আজকের মতো তাঁর জীবদ্দশায় কোনো কাপ ফাইনালে যেন হ্যাট্রিক না হয়। থলে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রিকের রেকর্ড অক্ষত রেখে তিনি ওপারে যেতে পারেন।

কে জানত সেই প্রার্থনাকে হাস্যকরতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে তিনি কিলিয়ান এম্ব্যাপে করবেন চার গোল.আর মেসি তিন। হার্স্টের একটা গোল নিয়ে আজও  বিতর্ক থেকে গিয়েছে যে বল ঠিকমতো গোললাইন ক্রস করেছিল কিনা? মারাদোনা তো ঠিকই বলতেন যে ইংরেজরা হ্যান্ড অব গড গোল নিয়ে এত কথা লেখে। ওদের নিজেদের চুরি নিয়ে তো টুঁ শব্দটি করে না। আজকের নায়ক ও বিজিতকে নিয়ে ভবিষ্যৎ তেমন কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস পাবে না।

ইংল্যান্ড মিডিয়া এত নেগেটিভ সব কথা লিখেছিল কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে। ঠিক যেমন পেছনে লেগেছিলো ব্রাজিলের। কাতারের রাজা শুধু পুরস্কারই ফিফা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হাসিমুখে তুলে দিলেন না, ফাইনাল ম্যাচের মহিমায় আরো বেশি করে আধুনিক সময়ের শ্রেষ্ঠ বিশ্বকাপ সংগঠন হিসেবে আলোকিত হয়ে থাকলেন। শতাব্দী সেরা ফাইনাল তো নিঃসন্দেহে। তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ম্যাচ।

কোনো জ্যোতিষী। কোনো বেটিং বাজে। কোনো বিশেষজ্ঞর কোনোরকম পূর্বাভাস  মেলেনি। কেউ জানতো গ্রিজমানকে তুলে নিতে হবে কোচকে ?কেউ জানতো গিরু-ফ্রান্সের আর এক সোনালী রেখা--তাঁকে যে তুলতে হবে ? কেউ জানতো যে ডি  মারিয়া সেমিফাইনাল খেলতে পারেননি। চোটের জন্য একই ভাবে মিস করেছেন ২০১৪ ফাইনাল। তিনি নেমে গোল  শুধু করবেন না। আর একটা গোলের পেছনে থাকা  পেনাল্টি আদায় হবে  তাঁর জন্য? কেউ ভেবেছিলো আলভারেজকেও পুরো সময় মাঠে রাখা  হবে না ?কেউ জানতো এম্ব্যাপে ফাস্ট হাফে চূড়ান্ত  নিরাশ করে  দর্শক সদৃশ উপস্থিতি রাখবেন  ? কেউ জানতো সেই এম্ব্যাপেই দ্বিতীয়ার্ধে এমন তোরজোড় শুরু করবেন যে আর্জেন্টিনা রক্ষণ বাদ  দিচ্ছি। মেসিরও সাময়িক  গ্রহণ হয়ে যাবে।

মনে হতে থাকবে যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ পাতালে। তার আগে আর্জেন্টিনা যেভাবে শুরু করেছিল তাতে মনে হচ্ছিল একটা টিম  তো শুধু খেলছে। আর প্রথমার্ধেই  ২-০ এগিয়ে যাওয়া তারা নিশ্চিন্তে জয়ী দেশের মেডেলগুলো গলায় পরবে। সুনীল গাঙ্গুলি ভালো ভাবে বঙ্গজ পাঠককে বুঝিয়েছেন যে ফ্রান্স হল ছবির দেশ। কবিতার দেশ। কিন্তু তখনকার মতো কবিতা , ছবি  আর গান তো আর্জেন্টিনীয়দের পায়ে। মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে।

মেসি অন্য ম্যাচে খেলায় ঢুকেছেন একটু দেরিতে। সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আড়াই মিনিট  থেকে তিনি ধ্বংসাত্মক। যেমন সেরা চ্যাম্পিয়নের নার্ভ তেমনি তাগড়া শরীর। বিপক্ষের  চোরাগোপ্তা হাত চালানোয় কানে যে প্রচণ্ড চোট পেলেন সেটা সামলানোর জন্য বিশ্বসেরা মনও লাগে।

কী করেননি মেসি! দুটো পেনাল্টি সহ তিনটে গোল। দুটো ফাইনাল পাস। দুটো গোলে তীব্রতম শট। অবিরাম দু দিকে বল বাড়িয়ে যাওয়া। এমনকি বিপক্ষ আক্রমণ বাঁচাতে হেড করে কর্নার করা। সবাই জানত আধুনিক ফুটবল ঈশ্বরের একটা পা। বাঁ  পা। আজ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোল তো ডান পায়ে  করলেন। ঈশ্বর যেন এই জবাবটাও চুকিয়ে দেওয়ার প্রতীক্ষারত ছিলেন।

তবু এত কিছুর পরেও তিনি আমার পুরোনো হেডলাইন অনুযায়ী- ব্যর্থ অমর প্রেম কাহিনী হয়ে থাকতেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজের  সাহায্য না পেলে। ক'দিন আগে মিডিয়া সেন্টারে আর্জেন্টিনার দু'জন সাংবাদিক বলছিলেন এমিলিয়ানো থাকলে নাকি ২০১৪-র ফাইনাল তাঁরা  হারতেন না। মারাকানার সেই গোলটা মিডিয়া গ্যালারির দিকে হয়েছিল। কাছ থেকে দেখেছিলাম বলে মৃদু প্রতিবাদ করি যে মারিও গোৎজে চেস্টট্র্যাপ করে যেভাবে কাছ থেকে ঠেলেছিলেন তাতে কিপারের কিছু করার ছিল না। সকালে  ইউ টিউবে জার্মানির গোলটা আবার দেখে। এবং অতিরিক্ত সময় শেষ হওয়ার ঠিক আগে এমিলিয়ানোর এগিয়ে এসে অব্যর্থ গোল বাঁচানো দেখে মনে হচ্ছে এড়ে তর্ক করছিলাম।

টাইব্রেকারে দুরন্ত বাঁচানো বাদ  দিচ্ছি। শেষ মিনিটে তার এগিয়ে এসে অব্যর্থ গোল বাঁচানো  না ঘটলে তো খেলার শেষে এম্ব্যাপেকে এত ম্রিয়মাণ লাগার কথা নয়। তখনই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা আবার খেতাব পেয়ে যায় ৪-৩। গোল্ডেন বল নিয়ে মেসির নিস্পন্দ হাঁটা আবার প্রত্যক্ষ করতে হয় বিশ্বকে। আমার কাছে ফাইনালের ওটাই টার্নিং পয়েন্ট।

আর বিশ্ববাণিজ্যের বাজারে বিভিন্ন খেলার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকা ফুটবলের টার্নিং পয়েন্ট- আজকের ফাইনালের মহাজাগতিক মান। নাহ, এই গ্রহে যতদিন একটি লোকও ফুটবলে কেউ লাথি মারবে, ততদিন জীবিত থাকবে মেসিয়ানার জ্যোৎস্নারাত!

গৌতম ভট্টাচার্য, সম্পাদক, জি নিউজ

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২২
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।