ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন

জুবেদা চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৬ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২৩
বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন

সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত ১৪ বছর ধরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করে আসছে।

ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি স্টেশন থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর রিসোর্ট টার্মিনাল পর্যন্ত ১৩১.৫৭ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে আড়াই থেকে তিন লাখ টন ডিজেল আমদানি করা হবে। খরচ কমানোর পাশাপাশি এটি জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য একটি বড় বলয় তৈরি করেছে। টার্মিনাল ও ডিপোতে দুই মাস ধরে অন্তত ৪০ হাজার লিটার জ্বালানি মজুদ করা হয়েছে।
আগামী ১৮ মার্চ, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পাইপলাইন যোগে ভারত থেকে ডিজেল আসা শুরু করবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যৌথভাবে এ প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন।  

বাংলাদেশ ও ভারত তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরেকটি সোনালী অধ্যায় রচিত হবে এই ডিজেল সরবরাহের মাধ্যমে। জ্বালানি সহযোগিতা নিশ্চিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের দেশটির সাথে ভৌগলিক নৈকট্যের সর্বাধিক উপযোগিতা নিশ্চিত হতে যাচ্ছে এই পাইপলাইনে ডিজেল আসার মাধ্যমে। পাইপলাইনটি আনুমানিক ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে যা বাংলাদেশকে ভারতের কনসেশনাল লাইন অফ ক্রেডিট এর অধীনে অর্থায়ন করা হয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন চুক্তি
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য নভেম্বর ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়, যার মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কাজের গতি কিছুটা মন্থর হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৩ পর্যন্ত। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণের কাজ বর্তমানে সমাপ্ত হয়েছে। ১৩১.৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং পার্বতীপুর, দিনাজপুরকে সংযুক্ত করে। পাইপলাইনের মোট দৈর্ঘ্যের মধ্যে ১২৬.৫০ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং বাকি ৫.০৭ কিলোমিটার ভারতে। ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের মোট নির্মাণ খরচ ৩০৬ কোটি টাকা। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা যাবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে আড়াই লাখ টন আমদানি করা হবে। ১৫ বছরের চুক্তি অনুযায়ী, আমদানির পরিমাণ বাড়বে বছরে ৪ থেকে ৫ মেট্রিক টন।

যেভাবে নিশ্চিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা
২০১৭ সাল থেকে রেলওয়ের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ ডিজেল বাণিজ্য চলে আসছে। প্রতি মাসে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে প্রায় ২২০০ টন ডিজেল পাঠানো হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির জন্য এই পরিবহন খরচ বেশ ব্যয়বহুল ছিলো। ১৮ মার্চ এই পাইপলাইন চালু হবার পর দেশে জ্বালানি সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে এবং রেলওয়েযোগে জ্বালানি পরিবহন খরচ কমবে।

আমন ও বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় সরকার পাইপলাইনের মাধ্যমে এই জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলায় ডিজেল গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে কৃষকদের তা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। ভারতের এই রপ্তানি শুধু ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে না বরং জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ডলার সংকটের সময়ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে সমুন্নত করবে। আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনটি নিরবচ্ছিন্ন, সস্তা এবং দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ নিরাপত্তা ছাড়াও রেলওয়েতে পরিবহনের কারণে ছোটখাটো চুরির মাধ্যমে যে সিস্টেম লস হয় সেটি কমাতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।  

এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য ডিজেল আমদানির বিকল্প উৎস তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে ৬.৫ মিলিয়ন টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এই আমদানিকৃত জ্বালানির ভেতর বছরে ৪ মিলিয়ন টন ডিজেল আমদানি করা হয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পরিবহন খরচ কমিয়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ আমদানি করা জ্বালানি এদেশে আসবে।

অধিকন্তু, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে জ্বালানি তেল (মালবাহী সহ) আনার জন্য প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) গড় প্রিমিয়াম ১১.৫০ ডলার খরচ পরে। ভারত থেকে পাইপলাইনে যদি এই জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় তবে ছয় ডলার খরচ পরবে। ব্যারেল প্রতি সাড়ে পাঁচ ডলার হ্রাসে প্রতি ১,০০,০০০ টনে প্রায় ৯.৭৫ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। জ্বালানি সরবরাহে কম সময় নেওয়ার পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

সমৃদ্ধ জ্বালানি সহযোগিতা
ভারত-বাংলাদেশের জ্বালানি সহযোগিতা নতুন কিছু নয়। এর পূর্বেও বিদ্যুৎ খাতের উন্নতিতে বাংলাদেশ ভারতকে পাশে পেয়েছে। শুধু তাই নয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রেও ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। ভারত ও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক জ্বালানি সহযোগিতার মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট জ্বালানির উচ্চ মূল্যের বৈশ্বিক সমস্যাটি মোকাবেলা করতে পারে। এরই প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি সহযোগিতার একটি অন্যতম উদাহরণ হবে। ভারত থেকে ১৮ মার্চ ২০২৩ তারিখ থেকে বাংলাদেশে যখন পাইপলাইনে ডিজেল আসতে শুরু করবে, তখনই এটি ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে জ্বালানি সহযোগিতায় একটি নতুন মাত্রার সূচনা করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।