সুস্থ-সবল চারা এবং ভালো উৎপাদন পেতে হলে ভালো মানের বীজ ব্যবহার অত্যাবশকীয়। ভালো জাত ও বীজের মান ভালো না হলে ভালো কৃষকের অর্থ, শ্রম, সময় যেমন নষ্ট হয় তেমনি ঘাটতি সৃষ্টি হয় দেশীয় উৎপাদনের ওপরে।
সম্প্রতি নামী দামী কোম্পানি এমনকি সরকারি বীজ উৎপাদন সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) ভালো বীজ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা মোড়ক পরিবর্তন করে বিক্রির ফলে কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকরা মোড়ক দেখে বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। অবিকৃত মেয়াদ উত্তীর্ণ বীজ নতুন মোড়কে স্থানীয়ভাবে মোড়কজাত করে আবারো বিক্রির ফলে আশানুরুপ গাছ জন্মাচ্ছে না। জন্মালেও ফলন আসছে না। মোড়কে একটি জাত লেখা কিন্তু জন্মাচ্ছে অন্য জাত। সারা দেশেই প্রতিনিয়ত খবর পাওয়া যায় বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা। কিন্তু কেনো? কৃষকরা কেনো বীজ কিনে প্রতারিত হবেন? এগুলো দেখার দায়িত্ব যাদের তারা কী করেন? আর কৃষকরা অভিযোগ করেই কি লাভ?
জেলা শহর, শহরতলী, উপজেলা শহর এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠান। নামে-বেনামে অনুমোদীত এমনকি অনুমোদনহীন এসব বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে মুনাফা অর্জন এবং কৃষকদের প্রতারিত করতে। তবে সব বীজই ভেজাল এ কথা বলা মুশকীল। কেন না ভেজাল বীজ শনাক্তকরণের যন্ত্র যেমন নেই কৃষকের হাতে তেমনি নেই বীজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের হাতে। মূলত এখন বীজ বাজার চলে হাওয়ার ওপরে। বিশ্বাস করলে বীজ নেবেন আর না করলে নেবেন না। কিন্তু ভালো বীজের সন্ধানে সব সময়ই হন্যে হয়ে ঘোরেন কৃষকরা। বীজের মান বোঝা যায় তখনই যখন কৃষক কাঙ্খিত ফলন না পায়। অনেক সময় কৃষক বুঝতেও পারে না তার ব্যবহৃত বীজটি ভেজাল ছিলো কি না। কেন না এ সংক্রান্ত কোনো প্রকার প্রশ্ন তোলা হলে তার দিকে ছুড়ে দেওয়া হবে হাজারো প্রশ্নের তীর। কিভাবে জমি চাষ করেছিলেন, কখন সেচ দিয়েছিলেন, কী ধরনের সার দিয়েছিলেন, কতবার নিড়ানী দিয়েছিলেন, ক্ষেতে ঠিকমতো কীটনাশক দেওয়া হয়েছিলো কি না। এমন হাজারো প্রশ্ন এড়িয়ে চলতে কৃষক আর কোনো প্রকার অভিযোগ তুলতে সাহস পায় না। তার ওপরে রয়েছে বীজ ব্যবসায়ীদের বিশাল এক সিন্ডিকেট। তাদের রয়েছে রাজনৈতিক বড় বড় পরিচয়ও।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, মোবাইলে একটা ফোন আসে এক কৃষকের কাছ থেকে। ৬০ বিঘা জমিতে লাভের আশায় কৃষি অফিসের পরামর্শে ও ইউটিউবে ভিডিও দেখে জমি বর্গা নিয়ে কয়েকজন কৃষক তরমুজের চাষ করেছেন। নামী একটি বীজ কোম্পানির ঝিনাইদহ এজেন্টের মাধ্যমে তরমুজ বীজ কেনেন কৃষকরা। পরে প্রায় ৬০ বিঘা জমিতে এসব বীজ বপন করেন। বীজ থেকে সময়মতো চারা গজিয়ে লতানো গাছে ক্ষেত ছেয়ে যায়। ফুলও ধরে। কিন্তু তরমুজ ধরে না। দু-একটি গাছে একটি-দুটি তরমুজ ধরলেও তা আকারে খুবই ছোট। বীজ কোম্পানির পরামর্শমতো কৃষকেরা ঠিক সময়ে সার, কীটনাশক দিয়েও কোনো ফল পাননি। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন চাষিরা। পরে জানতে পারে যে বীজগুলো ছিলো মেয়াদ উত্তীর্ণ। পরে এ ব্যপারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও কোনো ফল পায়নি কৃষকরা। নষ্ট হয় কৃষকের তরমুজ ক্ষেত, আশা ভেঙে যায়। এরপরে ওই এলাকায় আর চাষ হয়নি তরমুজ।
অনুমোদিত খুচরা সার-বীজ বিক্রেতার কাছ থেকে ধান বীজ কিনে মৌসুম শেষ হয়ে গেলেও ধানের শীষ বের না হওয়ায় গরুর ঘাস হিসাবে কেটে ফেলে কৃষক। পরে অভিযোগ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে। কিন্তু প্রতারিত কৃষকের কোনো লাভই হয়নি।
কৃষির রবি, খরিপ-১ এবং খরিপ-২ মৌসুমের মধ্যে রবি মৌসুমে শীতকালীন শাকসবজি উৎপাদন বেশি হয়। আবাদ ও ফলন দুইই ভালো হয় বোরো ধানের। এই রবি মৌসুমে শাকসবজির বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা প্রতিনিয়ত। খোলা বাজারে শাক-সবজির বীজ বিক্রির ধুম চলে। এই বীজ বাজার থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে নাম মাত্র মোড়কজাত করে আবার বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে কৃষকদের প্রতারিত করে অসাধু বীজ ব্যবসায়ীরা। বছরের পর বছরের অবিক্রিত সবজি বীজ ফেলে না দিয়ে নতুন করে আবার বাজারজাত করার ফলে সেই বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা।
রবি মৌসুমে বোরো ধানের বীজের চাহিদা বেশি থাকে। এর সুযোগ নেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। যে বীজের চাহিদা বেশি থাকে তার কৃত্তিম সংকট দেখিয়ে দাম বৃদ্ধি করে দেয়।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, মৌসুমে আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুমে দেশে ধান বীজের চাহিদার তুলনায় সরকারি সংস্থা (বিএডিসি, ডিএই, বিএমডিএ) এবং বেসরকারি সংস্থার মিলিয়ে শতকরা ৬৪ ভাগ বীজের যোগান দিয়েছিলো। বাকিটা কৃষক স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন করেছিলো। এছাড়া গম বীজের শতকরা ৪৩ ভাগ, ভুট্টার ৬৭ ভাগ, পাটের ৮২ ভাগ, ডালের ১২ ভাগ, তেলের ২১ ভাগ, আলুর ১৩ ভাগ। গড়ে দেশের চাহিদার ৩০ ভাগ বীজের যোগান ছিলো। বাকি কৃষকদের চাহিদা মিটেছিলো কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত বীজ থেকে।
একদিকে যেমন বাজারে বীজের সংকট দেখিয়ে দফায় দফায় নীরবে দাম বৃদ্ধি পায় অন্য দিকে সংকটে ভেজাল বীজ বিক্রি বেশি হয়। এমনকি সরকারি বিএডিসির বীজ কিনেও কোন কোন সময় প্রতারিত হয় কৃষকরা। তবে সব বীজ ভেজাল তা কিন্তু নয়। কৃষি প্রণোদনার বীজে আস্থা রেখেও কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ বীজ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা।
তবে বীজবাজির হাত থেকে সাধারণ কৃষকদের রক্ষা করবে কে? বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, গবেষণায় নতুন জাত সৃষ্টি, উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন, আধুনিক কৃষি সেবা, বীজ উৎপাদনে জোরদারসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাজারে ভেজাল বীজ বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাও করছে। কিন্তু তার পরেও কেনো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা?
ভেজাল বীজে বাজার সয়লাব। প্যাকেটের গায়ে উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী, আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম নেই। নেই বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির সিল। এজেন্সির লাইসেন্স থাকলে যে কেউ এভাবে প্যাকেটজাত ধান বীজ হিসেবে বিক্রি করতে পারেন। বীজ প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসে আছে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বীজ ব্যবসায়ীরা।
কৃষক বাঁচলে বাঁচবে আমাদের বাংলাদেশ। দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপশি বীজ সিন্ডিকেট ধ্বংস করে ভেজাল বীজ বিক্রি বন্ধ করতে করা সময়ের দাবি।
লেখক: কৃষি বিষয়ক কনটেন্ট নির্মাতা