ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ ভাদ্র ১৪৩১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: যৌক্তিকতা ও জটিলতা

সিজান আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪
বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: যৌক্তিকতা ও জটিলতা

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা হল এমন একটি আইনসভা যা দুটি পৃথক কক্ষ নিয়ে গঠিত, যেখানে একটি কক্ষকে ‘উচ্চ কক্ষ’ এবং অন্যটিকে ‘নিম্ন কক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত, এই ধরনের আইনসভায় আইন প্রণয়নে সমান ক্ষমতার ভারসাম্য বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নিশ্চিত করা হয়।

কারণ, সাধারণত এই ধরনের আইনসভায় নিম্ন কক্ষের সদস্যরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন এবং তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকে, তবে সেই আইন কার্যকর করতে উচ্চ কক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এইভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালু থাকলে জনগণের প্রতিনিধি (নিম্ন কক্ষ) তাদের নিজেদের স্বার্থে বা স্বৈরাচারী উদ্দেশ্যে কোনো ইচ্ছামত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তনের বিষয়টি কিছুটা জটিল। কারণ এটি তার ইতিহাসের শুরু থেকেই এককক্ষবিশিষ্ট রাষ্ট্র ছিল এবং কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ গঠন করে। পরিচালিত হয় এককক্ষীয় পদ্ধতিতে। তবে একটি এককক্ষবিশিষ্ট রাষ্ট্রকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় রূপান্তর করা কোনো অসাধ্য কাজ নয়। ২০১৫ সালে নেপাল একটি ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে বিভিন্ন অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের বৃহত্তর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করেছে। আর আমাদের ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে প্রতিবার যখন কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে, তারা স্রেফ অবিচার করেছে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের সংবিধানকে নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তন ও পুনর্গঠন করেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে স্বৈরাচার প্রসার করেছে।  

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট দেশ হওয়ায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা সম্ভব নয়, তবে এর জবাবে আমার যুক্তি হলো, ইংল্যান্ডের মতো একটি ছোট ভূগোলের দেশেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে এবং এটি যথেষ্ট মসৃণভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশের আইন আরও ভালোভাবে প্রণয়ন করা সম্ভব হবে, কারণ এতে বিলগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিতর্কে তোলার সুযোগ থাকবে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় বিলগুলো কোনোরূপ বিতর্ক ছাড়াই শাসক দলের পক্ষে পাস হয়ে যেতে পারে। এছাড়া দুটি কক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকার ফলে নির্বাহীদের জন্য দুটি কক্ষকে একসঙ্গে প্রভাবিত করা কঠিন হবে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষ উচ্চ কক্ষের কাজের চাপ হ্রাস করতে সহায়তা করবে। যেমন বড় বাজেটের বিল বা প্রস্তাবনা উভয় কক্ষে আলোচনা হবে এবং তাড়াহুড়ো করে কোনো বিল পাস হওয়া থেকে রক্ষা করবে, যা এককক্ষবিশিষ্ট পদ্ধতিতে ঘটতে পারে। এছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটাবে এবং দুটি কক্ষের মধ্যে বিল পাসের সময় বিলম্ব হওয়ায় বিলগুলো নিয়ে আরও বিতর্কের সুযোগ থাকবে। সর্বশেষে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যেখানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

বাংলাদেশের মতো এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা পরিচালিত একটি দেশকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় রূপান্তরিত করতে গেলে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক এবং আইনি সংস্কার প্রয়োজন হবে। তাই এই সংস্কারের জন্য একটি রোডম্যাপ এখানে প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংবিধান সংশোধন: বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ নং অনুচ্ছেদে এককক্ষবিশিষ্ট ‘জাতীয় সংসদ’র কাঠামো নির্ধারিত হয়েছে। তাই দ্বিতীয় কক্ষ প্রবর্তনের জন্য এই অনুচ্ছেদ এবং সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো সংশোধন করতে হবে। তবে বাংলাদেশের সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। এর অর্থ হচ্ছে, এই সংশোধনের জন্য ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন ও জনগণের মতামত ছাড়া এটি প্রায় অসম্ভব।

দ্বিতীয় কক্ষের নকশা (উচ্চ কক্ষ): দ্বিতীয় কক্ষের গঠন, ক্ষমতা এবং কার্যাবলি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে এটি দেশের এবং জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করে, বরং অতীতে দেখা স্বৈরাচারকে সমর্থন করার জন্য নয়। প্রাথমিকভাবে উচ্চ কক্ষের জন্য তিনটি নকশা প্রস্তাব করা যেতে পারে: i) সরাসরি নির্বাচিত (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে); ii) নিযুক্ত (যেমন যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস); iii) পরোক্ষভাবে নির্বাচিত (সংসদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত, যেমন ভারতের লোকসভার (নিম্ন কক্ষ) সদস্যরা রাজ্যসভার (উচ্চ কক্ষ) সদস্যদের নির্বাচিত করে)। আমার মতে, উচ্চ কক্ষের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হলো যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস-এর নিযুক্ত পদ্ধতি। কারণ এই কক্ষের সদস্য হতে হলে ‘peerage/aristrocracy’ হওয়া আবশ্যক, যা সর্বোচ্চ মানের সততা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় যেসব প্রকারের পিয়ারেজ প্রবর্তন করা যেতে পারে তা হলো:

সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে ‘পদত্যাগের সম্মাননা’ হিসেবে তাকে সুপারিশ করা যেতে পারে
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মীয় নেতা/স্কলার
ব্যাংকার, সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের নেতা; যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো লোকদেরকে উচ্চ কক্ষে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন পিয়ারেজ ব্যবস্থা এবং কেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো সরাসরি/পরোক্ষভাবে নির্বাচিত উচ্চ কক্ষের সদস্য নয়? আমার মতে, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটির অর্থনীতি স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ দেশের সিস্টেমে ‘দুর্নীতি’ নামক একটি সমস্যা বিদ্যমান। এই দুর্নীতি বাড়ার কারণ অনেক অশিক্ষিত লোভী রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় এসে জনগণের সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং জনস্বার্থে তা প্রয়োগ করেনি। তবে যখন আমরা পিয়ারেজ/অভিজাত শ্রেণীর লোকদের উচ্চ কক্ষে নিয়োগ করবো—যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি লোভ বা দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করেছেন—তখন তারা নিম্ন কক্ষে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ বিল/মোশনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হবে।  

আমার প্রস্তাব হলো, যেহেতু বাংলাদেশ আটটি বিভাগ নিয়ে গঠিত এবং এটি একটি ছোট রাষ্ট্র, তাই উচ্চ কক্ষে নয়জন সদস্য থাকা উচিত, যার মধ্যে আটজন তাদের নিজ নিজ বিভাগকে প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং নবম সদস্য পুরো কক্ষের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবেন।

আমি এমন কিছু সুবিধা বর্ণনা করেছি যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে, তবে এই ব্যবস্থা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো ব্যয়, কারণ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা পরিচালনা করা বেশি ব্যয়বহুল, যেখানে অতিরিক্ত বেতন, কর্মী এবং অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়, যা আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা আরও ব্যয়-সাশ্রয়ী করে তুলতে সক্ষম হবেন। অন্যটি হলো জটিলতা, কারণ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে ধীর করতে পারে এবং দুটি কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ থাকলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সফল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পদ্ধতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও সুষম দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তৈরি করতে পারে। এটি আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব বাড়াবে, আইন প্রণয়নের পর্যবেক্ষণ উন্নত করবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করবে, যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা আন্দোলনগুলো—যেমন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র মতো বিভিন্ন মতামত ও স্বার্থ জাতীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হবে। একটি সুস্পষ্ট সাংবিধানিক সংশোধনী, জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্য এবং উচ্চ কক্ষের নির্বাচন, গঠন ও ক্ষমতার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী প্রণয়ন এই পরিবর্তনকে সফল করতে অপরিহার্য।  

আমার কথায় কারও দ্বিমত থাকতে পারে কিংবা অন্য মতামত থাকতে পারে। তবে আমার মতে, এই কলুষিত সিস্টেমটা ঠিক করার জন্য এর থেকে ভালো প্রতিকার বোধ হয় আর নেই।

লেখক: আইনজীবী, হায়েস অ্যান্ড স্টোর সলিসিটরস, ক্যামব্রিজ, ইংল্যান্ড
 
বাংলাদেশ সময়: ২০২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।