ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ চৈত্র ১৪৩১, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০২ শাওয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ড. ইউনূস ক্ষমতায় থাকা মানেও এক সংস্কার

লুৎফর রহমান হিমেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৫
ড. ইউনূস ক্ষমতায় থাকা মানেও এক সংস্কার

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় একটি ঘটনার পর সারাদেশে যেখানে বিশাল বিশৃঙ্খলা থাকার কথা, সেখানে সরকার দারুণভাবে সব পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে।

দু-চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি শুধু সামাল দেওয়াই নয়, দারুণভাবে দেশ পরিচালনা করে চলেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।  

বরাবরই দেশের গণমানুষের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার বিষয় হয়ে থাকে নিত্য পণ্যমূল্য। অতীতে আমরা দেখেছি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম পরাতে পারেনি কোনো সরকারই। এ কারণে প্রায় সময়ই পত্রিকার পাতা ভরা থাকত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জনগণের নাভিশ্বাস, ক্রেতাদের হাহাকার— এ জাতীয় নানা সংবাদ শিরোনামে।  

কিন্তু ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গত ৫৪ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সেই পণ্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় লাগাম পরিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে রোজার মাসে সরকার সদাসর্বদা সতর্ক থেকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। রোজায় নিত্যপণ্যের বাজার এর আগে এতটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখেনি কেউ।  

কথায় আছে, এ দেশে মানুষের মূল্য কমে, আর জিনিসপত্রের দাম সবসময়ই বাড়ে। গত ১৬ বছর ধরে দ্রব্যমূল্য জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। বেশি দিন না, ছয় মাস আগেও ১৫ টাকা পিস দরে লোকজন ডিম কিনে খেয়েছে। এখন সেই ডিম কেনা যাচ্ছে আট টাকা পিস দরে! মানে দাম প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি! এত সস্তায় যে ইহজন্মে আমরা ডিম খেতে পারব, সেটা কি ছয় মাস আগেও ভেবেছিলাম আমরা? 

পেঁয়াজের কথাই ধরুন। ঈদ বা রোজার মতো কোনো উপলক্ষ এলেই দামের সেঞ্চুরি বা ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলে পেঁয়াজ। এখন সেই পেঁয়াজ ৪৫ টাকার আশপাশে! লাল চিনি মাস ছয়েক আগেও ছিল ১৭০ টাকা। এখন সেই চিনি কেনা যায় ১৪০ টাকার নিচে। দু-একটি নিত্যপণ্য বাদে সব পণ্যেরই দাম স্থিতিশীল রয়েছে বা কমেছে। বাজার হিসাবের ফর্দ নিয়ে পুরো রোজার মাসজুড়েই এক রকমের স্বস্তি নিয়ে কাটালেন দেশের মানুষজন।  

এদিকে রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের উৎসবও আরও রঙিন হয়ে ধরা দিয়েছে দেশবাসীর কাছে। এদেশে চিরায়ত চিত্র সড়কে নাড়ীর টানে ঘরে ফেরা যানবাহনের যাত্রীদের ভোগান্তি। এবার সেই দুর্দশার চিত্রও উধাও! ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িফেরা মানুষের প্রধান রুট ঢাকা-উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে কোনো যানজট নেই। হাইওয়ে পুলিশ ২৪ ঘণ্টা কঠোর শ্রম দিয়ে মহাসড়ক যানজট মুক্ত রেখেছে।  

একই দৃশ্য দেখা গেছে অন্যান্য মহাসড়কেও। প্রশাসনের আন্তরিক তদারকির কারণে মহাসড়কে নেই যানবাহনের বাড়তি চাপ, দুই-একটি ঘটনা ছাড়া স্বস্তির ঈদযাত্রা দেখা গেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় বাসস্টেশন মহাখালী বাস টার্মিনালে। যাত্রীদের অনেকে বলছেন, সড়কে যা ঘটেছে, তা বিশ্বাসই হচ্ছে না তাদের। লাইফে এত নির্বিঘ্নে ঈদযাত্রা তারা করতে পারেনি কখনও। ঈদের মধ্যে গত ৪০ বছরেও এমন দৃশ্য দেখেনি দেশের মানুষ।

সড়কের সঙ্গে সঙ্গে রেলেও দেখা গেছে সুশৃঙ্খলা। এতে করে যাত্রীদের মধ্যেও প্রশান্তির ছোঁয়া বিরাজ করছে। নিয়ম করে ঠিক সময়ে ছেড়ে যাচ্ছে সব ট্রেন। স্টেশনে নেই কোনো বাড়তি যাত্রীর চাপ। টিকিট কালোবাজারিরা লাপাত্তা! সব মিলিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের টিকিট পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে আগের সেই চিরায়ত হাহাকার কিংবা ক্ষোভ।  

শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণ বা ঈদে ঘরমুখো মানুষকে স্বস্তি দেওয়াই নয়, প্রবাসী আয় টানতেও গত কয়েক মাসে প্রবাসীদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে এ সরকার। মার্চ মাসের রেমিট্যান্সের দিকে তাকালে এটার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিন বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে এ মাসে। ঈদ উপলক্ষে রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়তে পারে—এমন ধারণা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু এভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ হাই জাম্প দিয়ে আকাশে উঠে যাবে, এমনটা ভাবতেও পারেনি কেউ।  

ধুঁকতে থাকা নাজুক ব্যাংকগুলোকেও সরকার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বুক উঁচু করে। সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের স্বার্থ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে বলে জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটির গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এসব ব্যাংকের আমানতকারীদের পাশে সরকার আছে। ব্যাংকগুলোর অবস্থা উন্নয়নে এগুলোর পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এরপরই আস্থা ফেরে ব্যাংকগুলোতে।

ব্যাংক খাত থেকে গত ১৭ বছরে বিভিন্নভাবে বড় ধরনের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। মূলত সাত-আটটি ব্যাংক থেকেই এই অর্থ বের হয়ে গেছে। ফলে এসব ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়েছিল। সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে দেয়নি। টাকা ছাপিয়ে দিলে তাতে করে দুই লাখ কোটি টাকা ছাপাতে হতো। এতে মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম—সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যেত। এরপর বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে সীমিত আকারে টাকা দিয়েছে। এসব ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত হিসেবে পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে টাকার নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি)। এভাবেই ব্যাংক খাতের বড় রকমের ঝুঁকি কাটিয়ে তুলেছে সরকার।

অর্থনীতি নিয়ে যাদের কিছুটা পড়াশোনা আছে, তাদের জানার কথা যে একটা দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা। সেই হিসাবে ড. ইউনূস সাহেবের প্রতি জনগণের আস্থাটা যে দিনকে দিন বাড়ছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এর প্রমাণও মিলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিডে লাখো মানুষ ড. ইউনূসের দেশ পরিচালনার প্রশংসা করছেন।  

অনেকে লিখছেন, এই সরকারকে আরও অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখা দরকার। কেউ কেউ লিখছেন, অন্তত দশ বছরের আগে ড. ইউনূস যেন দায়িত্ব না ছাড়েন। দেশের প্রধান প্রধান খাতের আমূল সংস্কার করার পরই যেন তিনি নির্বাচন দেন। কারণ, অতীতের কোনো সরকারই কথা রাখেনি। এবার রাষ্ট্র সংস্কারের এই সুযোগ ছাড়া যাবে না।

সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ড. ইউনূস প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘এই লোক রোজায় দ্রব্যমূল্য ঠিক রেখেছে; সারা বছর যেখানে এই সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, সেখানে উনি থাকায় বরং দ্রব্যমূল্য আশাতীত ভাবে কমেছে। ঈদের আগের চারদিন বাড়ি ফেরে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ; মানে প্রতিদিন ৩০ লাখ মানুষ ... কিন্তু এবার কোথাও নেই ভোগান্তি.. নেই ট্রেন-বাস-লঞ্চের কোন শিডিউল বিপর্যয়। এই ইয়াং হার্টের মানুষটা বেঁচে থাকুক অনেকদিন .... তার ক্ষমতায় থাকতে পারাটাই যে দেশের জন্য এক সংস্কার। ’

ড. ইউনূস ধীরে ধীরে স্টেটসম্যান হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন। তার চলার গতি ধীর এবং মাপা। তবে তার গন্তব্য এক প্রকার নিশ্চিত। ড. ইউনূস এমন এক অবস্থায় আছেন, তার আর পাওয়ার বা চাওয়ার কিছু নেই। দুনিয়ার তাবৎ সম্মানের যা যা পাওয়া সম্ভব, সেসবের সবগুলোই তিনি ইতোমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছেন।  

অধ্যাপক ইউনূসেরও নিজের জন্য কিছু করার প্রয়োজন নেই। এই দুনিয়ায় একজন মানুষ যতভাবে সম্মানিত হতে পারেন, তার সবটুকুই তিনি এরইমধ্যে পেয়ে গেছেন। ফলে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করাটা তার জন্য সহজ।

ড. ইউনূসের আগে এতটা দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতা নিয়ে এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন, এমন নজির নেই। তার আন্তরিকতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। দেশে তো বটেই, বিশ্বেও এমন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি ক্ষমতা ছাড়তে চান। ড. ইউনূস হলেন এমন একজন, যিনি ক্ষমতা ছাড়তে চাইলেও এ দেশের মানুষ বোধকরি তাকে ছাড়তে চাইবে না। কেনইবা চাইবে? তিনি ক্ষমতায় থাকা মানেও যে এক সংস্কার।

লেখক: সম্পাদক, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।