ঢাকা, শনিবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৪ জুন ২০২৫, ১৭ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

ইরানে ইসরায়েলের হামলা: কোথায় যাবে পরিস্থিতি?

সিরাজুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৩৬, জুন ১৩, ২০২৫
ইরানে ইসরায়েলের হামলা: কোথায় যাবে পরিস্থিতি? ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পর সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে

শেষ পর্যন্ত অনেকটা ঘোষণা দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর হামলা চালাল ইসরায়েল। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন প্রদেশে হামলা চালিয়েছে দেশটি।

হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি এবং ইরানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি খাতামুল আম্বিয়ার কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রশিদ শহীদ হয়েছেন। এর পাশাপাশি ইরানের ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানী শাহাদাত বরণ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া, ইরানের নাতাঞ্জ ও ফোর্দোসহ কয়েকটি পরমাণু স্থাপনা হামলার শিকার হয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা ইসরায়েলি হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ইসরায়েলের এই হামলার বিরুদ্ধে জনগণের প্রত্যাশামতো জবাব দিতে হবে। তিনি বলেছেন, ইসরায়েল এই হামলার মধ্যদিয়ে নিজের জন্য ‘তিক্ত এবং বেদনাদায়ক গন্তব্য’ বেছে নিল।

শুক্রবার সকালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বাণীতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ইসরায়েলকে কঠোর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, বেশ কয়েকজন কমান্ডার এবং বিজ্ঞানী শহীদ হয়েছেন। তাদের জায়গায় তাদের উত্তরসূরিরা এবং সহকর্মীরা কাজ শুরু করেছেন। ইরানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ইসরায়েলকে বিনা জবাবে পার পেতে দেবে না। ইরানের বিভিন্ন বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান শতাধিক ‘শহীদ কামিকাজে’ ড্রোন ছুড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরান এর মধ্যদিয়ে ইসরায়েলকে ইরানি হামলা মোকাবিলায় ব্যস্ত করে তুলবে এবং এরপরেই ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের ওপর হামলা করবে।
ইরান আগে থেকেই বলে আসছে, তাদের পরমাণুর স্থাপনায় যদি ইসরায়েল হামলা চালায় তাহলে ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনায়ও ইরান হামলা চালাবে। ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর মহড়াও চালিয়েছে ইরানি সেনাবাহিনী। এরইমধ্যে ইসরায়েল সরকার সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর দিচ্ছে যে, ইরান যেসব ড্রোন ছুড়েছে, তা ভূপাতিত করার জন্য ইসরায়েল তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করেছে এবং জর্দানের সামরিক বাহিনীও ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। এ ছাড়া, আমেরিকা ও ব্রিটেনের যুদ্ধবিমান ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করার চেষ্টা করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ইরাক, ইয়েমেন ও লেবানন থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের হামলার খবর পাওয়া যায়নি।

জানা যাচ্ছে, ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ইসরায়েল জ্যামিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে তারপরে ইরানের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ কাজে তারা ইরাকের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করেছে। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্কো রুবিও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আমেরিকা এই হামলার সঙ্গে জড়িত নয় বরং ইসরায়েল এককভাবে ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা না করতে ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যেমন ইরাক, বাহারাইন এবং কুয়েতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে জরুরি নয় এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগেই সরিয়ে নিয়েছে আমেরিকা।

ইসরায়েল এই হামলা চালাতে যাচ্ছে, সে কথা আমেরিকা জানতো। আমেরিকা ইসরায়েলকে এই হামলা চালাতে নিষেধও করেনি বরং ইসরায়েলকে সর্বকালীন সুরক্ষা দেওয়ার যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, তার আলোকে এই হামলার প্রতি ওয়াশিংটনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। আমেরিকার সবুজ সংকেত ছাড়া ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালাতে পারে না—সে কথা একেবারেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে কামিকাজে ড্রোন দিয়ে হামলা শুরু করেছে, সেসব ড্রোন ভূপাতিত করার জন্য আমেরিকা এবং ব্রিটেন তাদের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। ফলে এটি পরিষ্কার যে, আমেরিকা এবং ব্রিটেন যেভাবে ইসরায়েলকে সৃষ্টি করেছে, সেভাবেই তারা আজ পর্যন্ত দখলদার এই শক্তিকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে।

ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের জনজীবন অনেকটা স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আজ (১৩ জুন) শুক্রবার হওয়ায় সরকারি অফিস আদালত বন্ধ। এ ছাড়া দেশের বেশিরভাগ বাজার-ঘাট, দোকানপাট এবং কর্মক্ষেত্রে ছুটির দিন। ফলে জনজীবন অনেকটা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে এরইমধ্যে ইরানের পবিত্র কোম শহরে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার জন্য মিছিল হয়েছে। হামলার জন্য সৌদি আরব ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। চীন ও জাপান এই হামলার বিরোধিতা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একইভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি হামলার বিরোধিতা করে হামলা থেকে বিরত থাকায় আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে এই হামলা চলবে। তাতে হামলা শেষ করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।

ইসরায়েলের এই হামলা দীর্ঘ সময় ধরে চালানোর মানেই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের আনাচে কানাচে বৃহত্তর যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। লেবানন বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যতটুকু স্থিতিশীলতা ছিল, তা বিনষ্ট করার জন্য ইসরায়েল এই যুদ্ধ শুরু করল। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে যে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ইরানের পাল্টা হামলা চালানোর কথা। ইরানের হামলা ঠেকানোর জন্য আমেরিকা ও তার মিত্ররা যদি পদক্ষেপ নেয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বিরুদ্ধেও ইরান ব্যবস্থা নিতে চাইবে। সেক্ষেত্রে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোকে টার্গেট করতে পারে। বিষয়টি ইরান আগেই বলে রেখেছে। ইরান যদি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় তাহলে ন্যাটো সদস্য দেশ হিসেবে আমেরিকার পাশে জোটের অন্য সদস্যরা দাঁড়াতে পারে। বিষয়টি এমন হলে যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক হবে না, তা বৃহত্তর অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়বে। এই জায়গা থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুরও আশঙ্কা থাকতে পারে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যেহেতু কঠোর শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, সে কারণে ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো হবে—সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। পরিস্থিতি দেখে একথা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, দীর্ঘ ৪ দশকের বেশি সময় ধরে ইরান এবং ইসরায়েলের ভেতরে যে কঠিন দ্বন্দ্ব চলে আসছে, তার একটা চূড়ান্ত ফয়সালার সময় এসেছে। ইরানের পক্ষ থেকে বারবার ইহুদিবাদী ইসরায়েলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে এবার ইরানের বিরুদ্ধে মরণ কামড় দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমেরিকা ইসরায়েলকে রক্ষা করবে। তার মানে হচ্ছে, ইরান, ইসরায়েল ও আমেরিকার ত্রিমুখী সংঘাত এখন অনিবার্য। এমন সংঘাত হলে মধ্যপ্রাচ্য ও সারা বিশ্বের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি তারই ইঙ্গিত বহন করছে।

সিরাজুল ইসলাম: সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।