এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে, তখন বহু আকাঙ্ক্ষার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ১০ মাস শেষ। আর দুই মাসেরও কম সময়ে এক বছর পূর্তি হবে।
তবে গত ১০ মাসে আর কোনো খাতে কী সাফল্য-ব্যর্থতা বা অর্জন যাই হোক না কেন; অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য যে একটি কঠিন ক্রান্তিকাল পার করছে তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা।
সরকারের শুরুতে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা মহলের দিক থেকে অনেক প্রত্যাশা ছিল—হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে। লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার কমবে।
ডলারসংকট কাটবে। বেসরকারি খাতে ঋণ সহজলভ্য হবে। সুদের হার কমবে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলবে। বিদ্যুৎ-জ্বালানিসংকট কেটে গিয়ে কারখানা চলবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তায় সবার মধ্যে স্বস্তি আসবে। বাণিজ্য সংবাদিকতার সুবাধে প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়।
তাঁদের প্রায় সবারই এক কথা—এখনো তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং তাঁদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে কথা হলে তাঁরা এখন আর অভিযোগ করতে চান না। অনেকটা হতোদ্যমই বলা যায়। তাঁরা বরং এখন কায়মনোবাক্যে চান সংকট থেকে উত্তরণ।
এই লেখাটি যখন শুরু হয়, তখনই খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তথ্য জানা গেল। তাতে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে! গত মার্চ পর্যন্ত তা ছাড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার কোটির ঘর। মানে খেলাপি ঋণের আসল চিত্র বের হয়ে আসছে। এটি আগের সরকারের ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক খাতের বল্গাহীন লুটপাটের পরিণামই বলা যায়! আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে খেলাপি ঋণ গণনায় ছয় মাসের পরিবর্তে তিন মাস করায় খেলাপি ঋণের আসল চেহারা ভেসে উঠছে!
কিন্তু এভাবে খেলাপি ঋণ গণনার খারাপ দিক হলো—এতে ব্যবসায়ীরা ঋণের কিস্তি শোধে সময় কম পাচ্ছেন। কোনো কারণে একটি ভালো ব্যবসায়ীর সময় খারাপ গেলে, কিস্তি দিতে অসুবিধা হলেই খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। এতে বিদ্যমান ব্যবসাটি যেমন আরো রুগ্ণ হয়ে পড়ছে, আবার নতুন করে যে ঋণ পাবেন—এমন সুযোগও কমে যাচ্ছে।
আমাদের সংবাদকর্মীরা যেসব খবর দিচ্ছেন বা আমরা যেসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করছি বা উদ্যোক্তারা যা বলছেন, তাতে এটা অন্তত বলা যাচ্ছে, সত্যিকার অর্থে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলছে না। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী আইন-শৃঙ্খলার যে অবনতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছিল, তাতে এখনো পুরো লাগাম দেওয়া যায়নি। নানান তকমা দিয়ে বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী-শিল্প গ্রুপকে কঠোর নজরদারি, হামলা-মামলায় জড়ানোয় সাধারণ, ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তা ভীতির সংক্রমণ ঘটায়। ফলে তাঁরাও আস্থা ফিরে পাননি। ব্যবসায়ীরা তাঁদের পুঁজি এখন নতুন বিনিয়োগে লাগাতে চাচ্ছেন না। যার প্রতিফলন দেখা যায় বিনিয়োগচিত্রে। শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি বা যন্ত্রাংশ আমদানিতেও আশার চেয়ে হতাশার চিত্রই স্পষ্ট। মানে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে শিল্পের সম্প্রসারণ বা বিনিয়োগে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন। বিদেশিরাও এগিয়ে আসছেন না। তাঁরা দেখেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কী করছেন। যদি দেখেন স্থানীয়রা বিনিয়োগ করছেন না, চুপ করে বসে আছেন। তাঁরাও সাহস পান না। এ ঘটনাই বাংলাদেশে ঘটছে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে আগের সরকারের ফর্মুলা মেনে দফায় দফায় সুদের হার বাড়িয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেশ কমে গেছে। তা সর্বশেষ হিসাবে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে, যা থাকা উচিত কমপক্ষে ১৩ বা ১৪ শতাংশ। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাফ কথা, মূল্যস্ফীতি যতক্ষণ পর্যন্ত না সহনীয় হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সুদের হার কমছে না। ফলে কখন মূল্যস্ফীতি কমবে আর কখন সুদর হার কমবে আর বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিয়ে ব্যবসা বা উদ্যোগে বিনিয়োগ করবেন—তা বলা যাচ্ছে না।
আস্থাহীনতা, হামলা-মামলা, নজরদারি, বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণের মন্দার প্রভাব সরাসরি এখন সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে। ব্যবসায়ীরা কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা না করতে পারলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে রাজস্ব আয়ে। এখন পর্যন্ত অর্থবছরের ১১ মাসে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। মানে সরকার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও এই বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এর ফলে সরকারও বাজেট বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন খরচ মেটাতে সরকারকে আইএমএফের মতো বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে ধারকর্জ করতে হচ্ছে। দেশের ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদের পেছনে সরকারের শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে তা নয়; বরং সরকারকে তহবিল সরবরাহ করতে গিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমে যায়। তারা ঠিকমতো ঋণ পায় না। ফলে মানুষের কাজের সুযোগও সংকুচিত হয়। অন্যদিকে আইএমএফের কাছ থেকে তাদের সব শর্ত মেনে ঋণ নিতে হয়। ওই সব শর্ত মানার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা ও সংকট তৈরি হয়। মানুষে মানুষে কিংবা গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে অসন্তোষ বাড়ে, যা সরকারকেই আবার সামাল দিতে হচ্ছে।
সংকট যত বাড়ে, সরকারের কাছে মানুষের দাবি-দাওয়ার মাত্রাও বাড়ে। এটি এখন সরকার মোকাবেলা করছে। আশার কথা হলো, সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নির্বাচন এগিয়ে আনার একটি আভাস পাওয়া গেছে। এতে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তাঁরা এরই মধ্যে বলেছেন, যত দ্রুত নির্বাচন হবে, মানুষ আগামী পাঁচ বছর একটি স্থিতিশীল সরকারের নীতি-কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করবে। তখন একটা আস্থা ফিরবে। বিনিয়োগ আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবে।
কিন্তু নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হলেও এখনো আট মাস বাকি। ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলছেন, এই আট মাস কী হবে? তাঁরা কী হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত? এর মধ্যে কী নতুন বিনিয়োগ হবে না? ব্যবসার প্রসার ঘটবে না? মূল্যস্ফীতি বা সুদের হার সহনীয় হবে না? রাজস্ব আয় বাড়বে না? মানুষের চাকরি হবে না? হবে। সরকারই পারে এর সহজ সমাধান দিতে। এই সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ স্বনামধন্য আরো তিন অর্থনীতিবিদ দায়িত্বে রয়েছেন। কর্মজীবনে তাঁদের সুনাম প্রশ্নাতীত। তাঁদের এখন অন্তত অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির একটা চুলচেরা ও নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং সরাসরি তদারকি প্রয়োজন।
বাজেটে কি স্থানীয় শিল্পের কাঙ্ক্ষিত সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে? নাকি রাজস্ব বাড়াতে বিদেশি পণ্য আমদানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে? পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জিনিসপত্রের শুল্ক-কর ও ভ্যাট বসানো হয়েছে, নাকি রাজস্ব আয়কেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে? শুল্ক-কর আরোপের ফলে জিনিসপত্রের দামে এর কী প্রভাব পড়বে? মধ্যবিত্তরা টিকতে পারবে কি না—এসব তুলনামূলক পর্যালোচনা হয়েছিল কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।
মোট কথা, এখন অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমলাদের আগের সরকারের ফর্মুলা ও গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীদের দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে বসার বাস্তবতা তুলে ধরা উচিত। তাঁদের সমস্যা ও সংকটের কথাগুলো শোনা উচিত। সরকারের অন্য সব কাজের মধ্যে এদিকে বিশেষ নজর না দিলে সামনে অর্থনীতি যদি আরো নাজুক হয় তার নেতিবাচক প্রভাব সরকারের ওপরই বর্তাবে। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা, বেকারদের চাকরি দেওয়া, চাকরিজীবীদের দাবি মানা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতে গতিশীলতা আনা, মূল্যস্ফীতি সহনীয় করা এসবের চাপ সামলাতে হবে সরকারকেই।
পুঁজিবাজার পতনে পতনে প্রায় জেরবার অবস্থায়। এখানে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে আর্থিক প্রণোদনা বা নীতি সহায়তা দিতে হবে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের আস্থা ফেরাতে তাঁদের অভয় দিতে হবে। বিনিয়োগ ও ব্যবসা প্রসারে সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করতে হবে। রপ্তানির সব বাধা সরাতে হবে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতা বা অপপ্রচার ঠেকাতে হবে। ঋণখেলাপি কমাতে অসৎ ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে। পাশাপাশি সৎ ব্যবসায়ী ও যাঁরা অর্থনীতির মূল নায়ক, তাঁদের প্রয়োজনে নীতি সহায়তা দিতে হবে। আগের সরকারের মতো গতানুগতিক না হয়ে, উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গিতে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁরা কী চান, সরকার কিভাবে চায়—এসব বিষয়ে একটি ভারসাম্যের জায়গা তৈরি করা উচিত।
ক্ষমতার কেন্দ্রে যেসব সেরা অর্থনীতিবিদরা বসে রয়েছেন, কাজের অভিনবত্বে এর প্রতিফলন থাকা উচিত। সময় যা গেছে যাক; তার পেছনে না ফিরে সামনে যেটুকু সময় রয়েছে, একে যথাযথ কাজে লাগিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সত্যিকার অর্থে একটি উন্নত, বৈষম্যহীন দেশ গঠনে নজর দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে অর্থনীতি পুনর্গঠনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি বা কমিশন করা উচিত, যারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মোটাদাগে সব সমস্যার একটি শর্টলিস্ট করবে। কোন কোন সমস্যা আগে বা অগ্রাধিকারে সমাধান করা হবে তার একটি রোডম্যাপ তৈরি করবে। সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নেবে। অচিরেই এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত সরকারের পক্ষ থেকে। অন্যথায়, মানুষের কাজের সুযোগ না বাড়লে, বেকারত্ব বাড়লে, ব্যবসা-উদ্যোগে গতি না ফিরলে, নিরাপত্তাহীনতা থাকলে পরিণামে তা সরকারেরই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সৌজন্য: কালের কণ্ঠ